বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের একমাত্র আবাসিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) । নিজ দলের জুনিয়র নেতাকর্মীদের মারধর, নানা রকম সন্ত্রাসমূলক কাজ, সাধারণ শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের মারধর এই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) ঘোষণার পরবর্তী চার মাসে পাঁচটি অন্তঃকোন্দলসহ মোট আটটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে ঘটেছে পাঁচটি ঘটনা। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভুক্তভোগীসহ সাধারণ কর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য গত মঙ্গলবার থেকে আগের চার মাসের ঘটনা পর্যালোচনা করা হয়। তাতে আটটি ঘটনা উঠে আসে, যা প্রকাশ্য রাস্তায় একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন শুভ্র কুমার নামের একজন সাধারণ ছাত্র।
ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে শিক্ষার্থীদের একটি বাস থামানোকে কেন্দ্র করে শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শুভ্র কুমারের (পদার্থ-৪০তম আবর্তন) সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয় শহীদ সালাম-বরকত হলের ছাত্রলীগ কর্মী কার্তিক ঘোষ নীরবের। একপর্যায়ে নীরব ও আল বেরুনী হলের (সম্প্রসারিত ভবন) সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান প্রধানের (প্রতœতত্ত্ব- ৪১তম আবর্তন) নেতৃত্বে ছয়জন ছাত্রলীগ কর্মী বেদম পেটায় শুভ্রকে।
একই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, রাস্তা সংস্কার, আসবাব সংকট নিরসনসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে আল-বেরুনী হলের (সম্প্রসারিত ভবন) অফিস কক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিয়ে তালা মেরে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তবে এর পেছনের কারণ হলের মেস স্টুয়ার্ড পদে ছাত্রলীগের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে প্রভোস্টের সুপারিশ না করা বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-গণযোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক মো. সাদ্দাম হোসেনসহ (দর্শন- ৩৯তম আবর্তন) চার-পাঁচজন ছাত্রলীগ নেতা।
এর আগে ৩ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে আল-বেরুনী হল (সম্প্রসারিত ভবন) শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও পরিসংখ্যান বিভাগের ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী রাজু মাহমুদের দ্রুতগতিতে সাইকেল চালানো ও শহীদ রফিক-জব্বার হলের ৪৪তম আবর্তনের ৬-৭ জন ছাত্রলীগ কর্মীর রাস্তা দখল করে হ্াঁটাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে রাত সাড়ে ৯টার দিকে শহীদ রফিক-জব্বার হলের উত্তেজিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বটতলা পর্যন্ত গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা তাদের নিবৃত্ত করেন।
ওই ঘটনার জের ধরে পরদিন সকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আল-বেরুনী হল (সম্প্রসারিত ভবনের) ছাত্রলীগ কর্মী ইমরান খান সোহানকে (অ্যাকাউন্টিং- ৪২তম আবর্তন) রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ও পিঠে জখম করে শহীদ রফিক-জব্বার হলের জ্যেষ্ঠ কর্মী মাজেদ সীমান্তর অনুসারী জিতু, আহনাফ, বাপ্পীসহ আরও চার-পাঁচজন।
১ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে শহীদ রফিক-জব্বার হলের পার্শ্ববর্তী চায়ের দোকানে বসার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সাগর ও হাসানুল আলম রুবেলকে (ইংরেজি- ৪১তম আবর্তন) ধাক্কা দেয় মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী সিয়াম আহমেদ রাতুল (জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং- ৪৩তম আবর্তন)। এ সময় তাদের মধ্যে বাগবিত-া হয়। কিছুক্ষণ পর রাতুল তার হলের ৫-৬ জন শিক্ষার্থীকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে এসে সাগর ও রুবেলকে মারধর করে তাদের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ও দুুটি মোবাইল সেট ছিনিয়ে নেয়।
এদিকে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর জাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তিন দফা মারামারিতে লিপ্ত হয়। গত ১০ জানুয়ারি সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে কনসার্ট চলাকালীন আসন দখলকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও মওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। সেদিন রাতেই বিষয়টি মীমাংসার কথা বলে বটতলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের কর্মীরা মওলানা ভাসানী হলের কর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা করলে একজন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের ৭ জনসহ মোট ১০ নেতাকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাময়িক বহিষ্কার করে।
এসব বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেন। তারা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। আর যাও হয় তা সাময়িক বহিষ্কার, যা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। শাস্তি হলে তা জোটে জুনিয়র কর্মীদের কপালে। ঘটনার মূল হোতারা সব সময় আড়ালে থেকে যায়।
এ ছাড়া সিনিয়র ছাত্রনেতাদের কেউ কোনো পদে না থাকায় তা দলের চেইন অব কমান্ডে নিতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীকেই দেখা যায় না। এতে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া কাজকারবার সম্পর্কে জানতে চাইলে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা জানান তারা এ ব্যাপারে সতর্ক আছেন।
জুয়েল রানা বলেন, ‘এত বড় ক্যাম্পাসে মাঝেমধ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে থাকে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরাও সতর্ক থাকি যাতে এসব কর্মকা- করে কেউ পার না পায়।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি, আর কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। যেসব বিষয় মীমাংসা করার মতো, আমরা তা মীমাংসা করে দিচ্ছি।’