বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত বে টার্মিনাল নির্মাণের আইনি বাধাগুলো একে একে দূর হয়েছে। এখন দেশের অর্থনৈতিক গতিকে আরো জোরালো করতে এই টার্মিনাল নির্মাণেল অপেক্ষা। জানা গেছে, জোয়ারে ডুবে থাকা চরকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠবে বে টার্মিনাল। সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বে টার্মিনালের চার কিলোমিটারের বেশি অংশে গড়ে উঠবে এই ব্রেকওয়াটার্স। দুই ব্রেকওয়াটার্সের মাঝের প্রায় ৮০০ মিটার চ্যানেল দিয়ে আসা যাওয়া করবে জাহাজ।
উল্লেখ্য, ব্রেক ওয়াটার্স হচ্ছে উপকূলবর্তী প্রতিরক্ষা অংশ হিসাবে সমুদ্রপথের উপর নির্মিত কাঠামো। এই কাঠামো প্রতিকূল আবহাওয়া এবং উপকূলীয় খাদের প্রভাব থেকে জাহাজকে টিকিয়ে রাখে। এই পদ্ধতিটি উপকূলবর্তী স্রোতের তীব্রতা কমায়। এতে উপকূলবর্তী ক্ষয় কমে যায়। এতে প্রোতাশ্রয় রক্ষা পায়। সাগরে অগভীর জল থেকে ঢালু ডুবোচর সৃষ্টির মাধ্যমে এই ব্রেকওয়াটার্স তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, সম্প্রতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের ভিত্তিতে এভাবেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে প্রস্তাবিত বে টার্মিনালের। তবে শিগগিরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনায় গড়ে উঠবে গ্রিনপোর্ট হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরের আওতায় ‘নতুন বন্দর’ বে টার্মিনাল।
বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি ও প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইপিজেডের পেছন থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে বে টার্মিনাল। এরমধ্যে ইপিজেডের পেছন দিকে সাগরের প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে উত্তর দক্ষিণে লম্বালম্বি আকারে দুটি চর রয়েছে। এই চর দুটি জোয়ারে প্রায় ডুবে যায়। কিন্তু চর ও উপকূলের মধ্যবর্তী অংশে পানির গভীরতা ৭ থেকে ৮ মিটার- যা প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এবং দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার। সাগরের ভেতরের এই দুই চরকে শাসন করে ১৪ মিটার চওড়া ও ৫ থেকে ৬ মিটার উচ্চতার দেয়াল নির্মাণ করা হবে। আর এই দেয়ালটিই ‘ব্রেক ওয়াটার্স’। উপকূলের অংশে নির্মাণ হবে জেটি। জেটি ও ব্রেক ওয়াটার্সের মধ্যবর্তী জায়গায় এসে জাহাজগুলো প্রবেশ করবে।
জানা যায়, দুটি চরের মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় এক কিলোমিটারের মতো অংশ ফাঁকা রয়েছে, অর্থাৎ এই অংশে পানির গভীরতা ৭ থেকে ৮ মিটার রয়েছে। মধ্যবর্তী এই ফাঁকা অংশের চওড়া কমিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ মিটারে আনা হতে পারে। এই চ্যানেল দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জাহাজগুলো বে টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করবে। পণ্য উঠানামার পর আবার জাহাজগুলো যেদিক দিয়ে প্রবেশ করবে সেদিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। একসাথে দুই বা তিনটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে।
বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ জানায়, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের চওড়া কোথাও ৪০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ থেকে ২৫০ মিটার। এই চ্যানেল দিয়েই জাহাজগুলো জেটিতে প্রবেশ করে। এখন বে টার্মিনালের চ্যানেলের চওড়া ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার অনেক জাহাজ আসা যাওয়া করতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম বলেন, ‘আমরা সাগরের ভেতরের দিকে একটি ব্রেক ওয়াটার্স নির্মাণ করবো। দেশের কোনো বন্দরে এই সুবিধা প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে। সাগরের প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরের দিকে একটি চর থাকায় আমরা এই সুবিধা পাচ্ছি। আগামী মাসে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর বে টার্মিনালের চূড়ান্ত ডিজাইন করতে পারবো।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সিনিয়র হাইড্রোগ্রাফার হাসিবুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান ৭ থেকে ৮ মিটার ড্রাফটকে ড্রেজিং করে ১২ মিটার ড্রাফট পর্যন্ত করা যেতে পারে। এতে ভাটার সময় হয়তো ১০ মিটার ড্রাফট ও জোয়ারের সময় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বে টার্মিনালে ভেড়ানো যাবে। আর ৭০০ থেকে ৮০০ মিটারের চ্যানেল হওয়ায় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ এখানে ভেড়ানো যাবে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তে পারে। তাও শুধুমাত্র জোয়ারের সময়।
হাইড্রোগ্রাফার হাসিব আরও বলেন, সাগর থেকে আসা বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে যাতে জেটি নষ্ট না হয় সেজন্য দূর থেকেই ঢেউটিকে বাধা দেয়ার জন্য ব্রেক ওয়াটার্স নির্মাণ করতে হয়।
জানা যায়, বিশ্বের অনেক বন্দরে কৃত্রিমভাবে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু বে টার্মিনালের সাগরের অংশে এ ধরনের একটি ডুবোচর থাকাতে প্রাকৃতিকভাবেই ব্রেক ওয়াটার্সের সুবিধা পাওয়া গেছে। এখন শুধু এই প্রাকৃতিক চর শাসন করে ব্রেক ওয়াটার্সটিকে আরো একটি শক্তিশালী করা হচ্ছে। এরফলে উপকূলের দিকে থাকা জেটি নিরাপদ থাকে।
বে টার্মিনালের নির্মাণের সম্ভাব্যতা জরিপের জন্য জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের সাথে গত বছরের ১৭ আগস্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকায় প্রতিষ্ঠান ৯ মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা জরিপের কাজ শেষ করার কথা। আর তা হলে কোথায় কিভাবে টার্মিনালের নির্মাণকাজ করা যাবে সে বিষয়ে পাওয়া যাবে দিক নির্দেশনা। একইসাথে টেকনিক্যাল, ইকোনিমিক্যাল, এনভায়রনমেন্টাল, অপারেশনাল, ফিনান্সিয়াল ও ট্রাফিক ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট রিপোর্টও পাওয়া যাবে। সেই হিসেবে আগামী মে মাসের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
একদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট পাওয়া এবং অপর দিকে ভূমি বরাদ্দ পাওয়ার পর দ্রুত ইয়ার্ড নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করবে বন্দর। ভূমি বরাদ্দের কাজও অনেক এগিয়ে গেছে। এখন শুধু কতো মূল্যে তা বরাদ্দ দেয়া হবে সেবিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে নৌ মন্ত্রণালয়ের দর কষাকষি চলছে।
বে টার্মিনাল দ্রুত গতিতে নির্মাণের জন্য গত মাসে অনুষ্ঠিত বন্দরের উপদেষ্টা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়। সেই সভায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বে টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। উপদেষ্টা কমিটির ওই সভায় প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দ দেয়ার দাবি উঠে।