কন্ডাক্টর ২০ টাকা হাতে দিতেই ভিড় ঠেলে পেছন থেকে সামনে চলে গেল। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে টঙ্গী কলেজগেট ভাড়া কত? চিন্তা করছি। হিসাব মিলছে না। সিটিং সার্ভিস থাকতে সুপ্রভাতে এই পথে যেখানেই নামি ভাড়া ২০ টাকাই দিতে হতো। এখন তো এসব সিটিং বাহন বন্ধ। তাহলে ২০ টাকাই যে নিয়ে গেল? বাস যাত্রীতে ঠাসাঠাসি। পেছন থেকে কন্ডাক্টরকে দেখা যাচ্ছে না যে, ডাকব। এই সময়ের মধ্যে সামনে ভাড়া নিয়ে দু-একজনের সঙ্গে উচ্চবাচ্য শোনা গেল। পেছন থেকেও দু-একজন তাল মেলালো তাতে। জানতে চাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না আসলে ভাড়া কত? অপেক্ষায় আছি। বেটা যদি একবার পেছনে আসে।
এর মধ্যে দুদিন আগে ফার্মগেট থেকে চেপেছি সাবেক ৩ নম্বর, সদ্য বিলুপ্ত এয়ারপোর্ট-আব্দুল্লাহপুর পরিবহনে। ৩ নম্বর মুছে ফেলে এই গণপরিবহনটি রাতারাতি কীভাবে যেন সিটিং হয়ে উঠেছিল। টের পাইনি। টের পেলাম একদিন ভাড়া মেটাতে গিয়ে। শাহবাগ থেকে উত্তরা যেতে যেখানে ১৩ টাকা দিলেই বাসকর্মী মিষ্টি হেসে চলে যেত সেই কি না ভাড়া হাঁকলো ৩০ টাকা! করার কী আছে? যেতে হবে। তাই গিয়েছি। চড়তে হবে। অগত্যা তাই চড়েছি। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েছি। এখন যখন সিটিং উঠে গেল তখন? যাচ্ছিলাম ফার্মগেট থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং। ভাড়া কত? জানতে চাইলে কন্ডাক্টর বলল, দেন।
: কত দেবো?
: আরে দেনতো মামা।
: কত দেবো?
: বললাম না দেন, যা খুশি।
নিম তিতা মুখ করে কন্ডাক্টরের এমন কথাবার্তার আগা-মাথা কিছুই বুঝলাম না। যা খুশি মানে কী? বললাম, সিটিং তো উঠে গেছে। এখন ভাড়া কত?
: ৫ ট্যাকা কম দেন।
৫০ টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে বললাম, পাঁচ টাকার জন্য এতকিছু? তাহলে তো সিটিং-ই ভালো ছিল।
বাকিটা ফেরত দেয়ার জন্য ভাঁজ করা টাকাগুলো নাড়তে নাড়তে কন্ডাক্টর বলল, আমগোর কী? আপনেরা যেমনে কন হেমনেই।
বুঝলাম এসব সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়ার নামে যা হচ্ছে তাতে গণপরিবহন মালিকদেরই পোয়াবারো। কারণ, আগে গাড়ি চলতো সিট হিসাব করে। ভাড়া হয়ে গিয়েছিল লোকালের দ্বিগুণ। স্বস্তি এতটুকুই ছিল যে, দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হতো না। আর এখন সিটিং তুলে দেয়ার পর সিট হিসাব করে গাড়ি চলে না। পা ফেলার জায়গাও খালি রাখা হয় না। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা হয় বাসে। ভাড়া যা কমেছে তা না কমার মতোই। সর্বোচ্চ ৫ টাকা। তার ওপর ‘যদু’ মার্কা যাত্রী হলে তো কথাই নেই। আস্তে করে আগের ভাড়াই রাখবে আপনার থেকে। লাভের মধ্যে এতটুকুই হয়েছে যে, যাত্রীরা ফিরে গেছেন সেই বাদুর ঝোলার যুগে।
সুপ্রভাতের কন্ডাক্টরও বোধকরি আমাকে যদুদের তালিকায় রেখেছে। তা না হলে ২০ টাকা হাত নিয়ে এভাবে চলে যেতো না। যা হোক, গন্তব্যের কাছাকাছি আসতেই কন্ডাক্টরকে পেছন থেকে ঘাড়ে শক্ত করে চাপ দিলাম। টের পেল বলে মনে হলো না। এবার একটু জোরে চাপ দিতেই পেছন দিকে ফিরে তাকালো। চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল, কী হইছে এমন করেন ক্যান?
: ভাড়া কত?
: কোন থাইক্যা উঠছেন?
: কেন তোমার মনে নাই?
: মনে থাকলে জিগাই নাকি।
: বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে।
: নামবেন কই?
: টঙ্গী কলেজগেট।
: দিছেন কত?
নে বাবা। বাসে উঠে ভাড়া দিতেও দেখি লম্বা ইন্টারভ্যু দিতে হচ্ছে। এমনিতেই বাইরে প্রচ- রোদের তাপ। তার ওপর কন্ডাক্টরের আচরণে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কত দিয়েছি তা পরে হবে। আগে বলো ভাড়া কত?
: ১৫ ট্যাকা।
: সিটিংয়ে কত ছিল?
: ২০ ট্যাকা।
: তাহলে পাঁচ টাকা ফেরত দাও।
কন্ডাক্টরের হাবভাবে মনে হলো তিনি আমায় পাঁচ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে অনেক বড় দয়া করেছেন। দয়ার দান আমি পকেটে গুজে নিয়ে নেমে গেলাম। এই শহরে আমরা রাঙা-ধলাদের দয়ার পাত্র। সম্রাট শাজাহানদের প্রজা। তারা দয়া করছেন বলেই না আমরা চলে-চিন্তে খাচ্ছি। যদি একবার তারা বলে বসেন, ‘খামোশ’, তবেই সেরেছে। রাস্তা থাকবে। মাগার যানবাহন থাকবে না। খাদ্য সংকট কাটিয়ে ওঠা দেশের রাজপথে হঠাৎ করে নেমে আসবে পরিবহন সংকট!
আমাদের সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বাহাদুরও (ওবায়দুল কাদের) অসহায় যেন। বলেছেন, ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী।’
ইংরেজদের কুটিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা অসহায় হয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে।’ আজ রাঙা-শাজাহানদের ষড়যন্ত্রের শিকার সাধারণ মানুষের একজন আমারও ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেÑ ‘বাংলার রাজপথে আজ গণপরিবহন দুর্যোগের ঘনঘটা। কে আমাদের আশা দেবে, কে আমাদের ভরসা দেবে। মুক্তি দেবে এই রাহুর গ্রাস থেকে?’
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ : সাংবাদিক