দেখতে সুন্দরী। পাপিয়া। খয়েরি ডানার ছোট্ট সুন্দর পাখির নামেই নাম মেয়েটির।  কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাপিয়ার নাম শুনলে কেঁপে উঠেন মোহাম্মদপুর, আদাবর এলাকার লোকজন। পুরো নাম ফারহানা আক্তার পাপিয়া। অস্ত্র ও মাদক জগতের পরিচিত মুখ তিনি। একের পর এক মামলার আসামি হয়েছেন। কারাভোগ করেছেন। জুটেছে মাদকসম্রাজ্ঞি তকমাও। শুধু পাপিয়া নন, রাজধানীজুড়ে এরকম সহস্রাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে দুর্ধর্ষ তিন শ’ জনের তালিকা রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। তাদের প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। অভিযোগ, মামলা, গ্রেপ্তার কোনো কিছুতেই থেমে থাকে না তারা। বরং অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। পর্দার আড়ালে রয়েছেন তাদের আশীর্বাদদাতারা। যারা থাকেন সব অভিযোগ ও মামলার বাইরে। কিন্তু মাদক বিক্রির  টাকার একটি বড় অংশ পান তারা। মাদকের ‘ডিলারদের’ রয়েছে হাজার-হাজার খুচরা বিক্রেতা। খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে যায় মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উত্তর) মোহাম্মদ খোরশিদ আলম বলেন, প্রতি ডিলারের গড়ে অর্ধশত মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতা রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য মাদক ব্যবসায়ীদের একটি অংশ নারী। সূত্রমতে, পাপিয়ার মতো মাদকের শত নারী ডিলার রয়েছে রাজধানীজুড়ে। দেশব্যাপী বিস্তৃত পাপিয়ার নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা আমদানি করে আনা হয় ঢাকায়। চট্টগ্রামের হোসাইন নামে এক মাদক ব্যবসায়ী তা পৌঁছে দেয় পাপিয়ার ভাসুর রাহীর কাছে। পরবর্তীতে পাপিয়া ও তার স্বামী জয়নাল আবেদিন বাচ্চু ওরফে পাচু ওরফে জয় দু’জনে তা ছড়িয়ে দেয় মাঠ পর্যায়ে। মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, আদাবর, শ্যামলী ও মিরপুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অন্যতম হোতা পাপিয়া। ঢাকা থেকে পাপিয়া চক্রের মাধ্যমে মাদক ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। সর্বশেষ গত বছরের ৪ঠা ডিসেম্বর আদাবরের শেখেরটেকের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় পাপিয়াকে। এ সময় তার বাসা থেকে একটি পিস্তল ও লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ইয়াবা জব্দ করা হয়।
দীর্ঘদিন থেকে পাপিয়ার বাসা থেকেই ইয়াবা বিক্রি করা হতো। মাদক ব্যবসার স্বার্থে মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লায় বাসা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিতো পাপিয়া-বাচ্চু দম্পতি। ইয়াবা বিক্রির জন্য তাদের রয়েছে অন্তত অর্ধশত কর্মীবাহিনী। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার জয়েন্ট কোয়ার্টারের ৭/৪/এ নম্বর বাড়িটি তাদের হলেও মাদক ব্যবসার স্বার্থে বসবাস করে আদাবরের ছয় নম্বর সড়কের ১০৯ নম্বর জাপানি বাড়িতে। সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এ বিষয়ে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদাবর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বলেন, পাপিয়ার মাদকের নেটওয়ার্ক রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছে এই চক্র। গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার আবু হানিফের মেয়ে পাপিয়া যখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তখনই তার প্রতি নজর পড়ে এলাকার তরুণ মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন বাচ্চুর। ওই সময়েই বাচ্চুর প্রেমে পড়ে পাপিয়া। একপর্যায়ে বিয়ে করে তারা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান বাচ্চু ছোটবেলা থেকেই ছিঁচকে চুরিতে অভ্যস্ত ছিল। এক পর্যায়ে নিজের ভাইদের নিয়েই এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই পরিবারের সবার পেশাই এখন মাদক ব্যবসা।
মাদকের সম্রাটের নাম ইসতিয়াক। মাদক ব্যবসা করে এখন জিরো থেকে হিরো। মিরপুর, দারুসসালাম, শ্যামলী, আদাবর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি পর্যন্ত বিস্তৃত তার মাদকের জাল। তার শত শত লোকজন প্রতিদিন বিক্রি করছে মাদক। ইসতিয়াকের চেহারা দেখেননি কিন্তু তার নামে জানেন অনেকে। মাঝে-মধ্যে বিলাস বহুল গাড়িতে করে মাদকের পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে আসা-যাওয়া করে। ইসতিয়াক থাকে সাভার এলাকায়। ৩৫ বছর বয়সী ইসতিয়াকের জন্ম মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে। ছোটবেলা থেকেই চুরি-ডাকাতিতে অভ্যস্ত। এক পর্যায়ে আরশাদ নামে আরেক মাদক ব্যবসায়ীর গাঁজা বিক্রি করতো ইসতিয়াক। মাত্র ছয় বছর আগের কথা। নিজেই শুরু করে ইয়াবা, ফেন্সিডিল ও গাঁজা বিক্রি। পাইকারি ও খুচরা। মাঠে কাজ করে তার শত শত কর্মী। বদলে যায় ইসতিয়াকের চেহারা। বিলাস বহুল গাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক এখন ইসতিয়াক। সূত্রমতে, হেমায়েতপুরে রয়েছে তার ১০০ কাঠা জমি। শুধু তাই না ইসতিয়াকের রয়েছে পার্সনাল সেক্রেটারি। তার নাম আদনান তানভির। তানভির নিজেকে কখনও মানবাধিকারকর্মী ও কখনও সরকারি দলের নেতা পরিচয় দিতো। এখন সে ইসতিয়াকের বাণিজ্যের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেলেও নিরাপত্তার স্বার্থে তানভীর থাকে হেমায়েতপুরে। তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে নানা অভিযোগ। ইসতিয়াক একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে বর্তমানে প্রভাবশালী এক নেতার ছত্রছায়ায় নিজেকে নিরাপদে রেখেই ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে এলাকাবাসী জানান। ইসতিয়াক, মিরপুরের মাদক ব্যবসায়ী কাল্লু ও মোহাম্মদপুরের ইকবাল মিলে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। ইকবাল ছিল বিহারিদের সংগঠন ইউএসপিওয়াইআরএম’র সিনিয়র সহ-সভাপতি। মাদকের অভিযোগ থাকায় তাকে বহিষ্কার করে ওই সংগঠন। পরে যোগ দেয় বিহারিদের সনাতন সংগঠন এসপিজিআরসিতে। মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে সেখান থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারার মাদক সম্রাট ফজলুল করিম। একাধিক গাড়ি, বাড়ির মালিক। নিজে ব্যবহার করে এলিয়ন গাড়ি। ২০১৬ সালের মার্চে তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তার স্ত্রী ও ভাইয়ের স্ত্রী মাদক সরবরাহ করে বিভিন্ন বাসা ও পাঁচ তারকা অভিাজত হোটেলের পার্টিতে। পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানার বেওয়ারি গ্রামের মোবাশ্বের আলীর পুত্র ফজলুল করিম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শামছুল আলম বলেন, ইসতিয়াক ও ফজলুল করিম ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
মাদকের আরেক সম্রাজ্ঞী পারভিন আক্তার। পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব সুন্দরী। অবাধে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করছে সে। রাজধানী ও বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার মাদকের হাট। এ মরণনেশার ব্যবসায় পারভিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তার বান্ধবী সাহেনা আক্তার রাশি। পারভিন-রাশি মিলে সদর-ঘাট কেরানীগঞ্জে গড়ে তুলেছে বিশাল চক্র। কেরানিগঞ্জের কালিগঞ্জ বড় মসজিদ রোডের ইউনুস বেপারী লেনের বাসিন্দা পারভিনকে এক নামেই চিনে এলাকার সবাই। পারভিনের প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না কেউ। পুলিশকে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পারভিনের সঙ্গে মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছে তার পুরো পরিবার। নিউ ইস্কাটনের গাউস নগরে যুবলীগের নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা করছে মিঠু, কলাবাগানের কাঁঠালবাগানের জেন্ডার গলিতে বিপ্লব। মাত্র এক বছরে প্রাইভেট কারের চালক থেকে এখন যুবলীগ নেতা। এই পরিচয় ব্যবহার করে অবাধে করে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। গেণ্ডারিয়ার মাদক ব্যবসা করছে ছাত্রলীগ নামধারী রিয়াদ, যাত্রাবাড়ীতে সায়েম। তাদের ক্রেতা মূলত এলাকার শিক্ষিত তরুণরা। সায়দাবাদের মাদক সম্রাজ্ঞী সুফি। মাদারীপুরের মেয়ে মুক্তার হোসেনের স্ত্রী সুফি দীর্ঘদিন থেকে সায়দাবাদের ওয়াসা রোডে গড়ে তুলেছে মাদকের আস্তানা। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আমদানি করে সুফি চক্র। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আনে ফেন্সিডিল। একাধিক মামলা থাকলেও মাদক ব্যবসা থেকে দূরে নেই সুফি। স্বামীর হাত ধরে মাদকরাজ্যে পা রাখলেও তার নিজের পরিচিতিই বেশি। ঢাকায় একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক এখন এই নারী। আরেক সম্রাজ্ঞীর নাম পারুল ওরফে পারভিন। কুমিল্লা সদরের খেতাশা গ্রামের আলমগীরের স্ত্রী পারভিন। যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচায় থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ওই এলাকার মাদক ব্যবসা। মাদক বহন করার জন্য তার রয়েছে ১০-১২ জন তরুণী। তারা ভ্রমণের নামে প্রায়ই কক্সবাজার ও টেকনাফে আসা-যাওয়া করে। কৌশলে অন্তর্বাস ও জুতার সোর্ট বা হিলের ভেতরে এবং মোবাইলফোনের ভেতরে এবং কখনও কখনও নিজের ব্যাগে ইয়াবা বহন করে। কাজলা ২/২৯ নম্বর বাসাসহ একাধিক ভাড়া বাসা রয়েছে এই চক্রের। পারভিনের স্বামী শামীম এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। মাদক ও মানব পাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ৯৬২৮টি মামলা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে হয়েছে ১০৪৮টি মামলা। বিপুল মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। প্রায়ই অভিযান হচ্ছে। মাদক বিক্রেতারা গ্রেপ্তার হচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আরো রয়েছে মোহাম্মদপুরের পঁচিশ ওরফে চোয়া সেলিম, রানী, মুন্না, আসাদ, মাহবুব, চুলা, সেলিম, সাহাবুদ্দিন, মাহিনা আক্তার সাথী, নার্গিস, সায়রা, রেশমা, কুলসুম, জিপু, নাসির, কালু, জাহিদ, সনু, টেলু আরমান, শামীম, সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ এলাকার পারভীন, পাপন, সৈয়দ আলী, আল-আমিন, ইয়ামিন, সায়দাবাদ এলাকার ময়না, যাত্রাবাড়ীর হাবিব, সেলিম রেজা, দেলোয়ার হোসেন, যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ গোলাপবাগের সাইফুল ইসলাম, আহাদুল ইসলাম, শ্যামপুরের পোস্তগোলা রাজাবাড়ির হাছিনা বেগম, ইসলামবাগের ছাফি, গেণ্ডারিয়ার শিলামণি, ডেমরার নাসির, বংশালের সেলিম, ওয়ারির আমীর হোসেন, আলশাহরিয়ার রোকন, পূর্ব রামপুরার এনএস সড়কের মর্জিনা বেগম, কাওসার আহমেদ, কুতুব উদ্দিন রণি, মিরপুর-১১ এর বি ব্লকের কাল্লু, উত্তরার আশকোনার জ্যোতি, জাবেদ, মনোয়ারা, বিল্লার হোসেন, কাওরানবাজারের মিনা, শাহিদা, পারভিন, কুটি, রবিউল, শুক্কুর, নিশি, খিলগাঁওয়ের আজিজ, গুলশান নিকেতনের অঞ্জনা, উত্তরার বাসিন্দা এক সময়ের চলচ্চিত্রের নায়িকা নদী, লালবাগের মনোয়ারা, আনন্দবাজার বস্তির বানু নিমতলী বস্তির সাবিনা, পারুল, মহাখালীর ইভা ও রওশন আরা, বনানীর আইরিন, কড়াইল বস্তির রিনা, বিউটি, গুলশানের মৌ, বারিধারার নাদিয়া, উত্তরার গুলবাহার, মুক্তি সহ আরও অনেকের নাম।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশনস) ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ বলেন, ঢাকায়  মাদকের অন্তত ৩০০ ডিলার পর্যায়ের ব্যবসায়ী রয়েছে। তাদের আমরা নজরদারি করছি। অনেককে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেছি। মাদক প্রতিরোধ করতে কঠোর আইন-প্রয়োগের পাশাপাশি সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031