৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তিনি। একজন সফল নগর পরিকল্পনাবিদ।  বৃটেন থেকে অর্জন করেছেন নগর পরিকল্পনা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি। বুয়েটে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সঙ্গে। পরিবারে মা, স্ত্রীসহ অনেকেই শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও ওই শিক্ষকজীবন তাকে টানেনি। চেয়েছেন ভিন্ন কিছু করবেন। আশির দশকের কথা। দেশে তখন ব্যক্তি খাতে নতুন হাওয়া বইছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পেশাগত শিক্ষার সঙ্গে তাল রেখে আবাসন শিল্পের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শেলটেক লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম. সেরাজ।
লেখালেখির নেশাও রয়েছে তার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা তার নগর পরিকল্পনা ও আবাসন নিয়ে প্রকাশিত একাধিক বই রয়েছে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে আবাসন খাত নিয়ে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। নগর পরিকল্পনা ও প্রাইভেট সেক্টর হাউজিং নামে দুটি বইও লিখেছেন তিনি। বৃটেন থেকে নগর পরিকল্পনায় করা পিএইচডির থিসিসটি তৎকালীন সরকার বই আকারে প্রকাশ করেছিল। এখনো মাঝে মধ্যে লিখছেন বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তি, আধুনিক মনস্ক এই মানুষটির হাত ধরে গড়া প্রতিষ্ঠান শেলটেক-এর ৩ দশক উদযাপন উপলক্ষে খোলামেলা আলোচনা হয় মানবজমিনের সঙ্গে।
আবাসন খাতের সূচনার দিক নিয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং সোসাইটির (রিহ্যাব) সাবেক  সভাপতি ড. তৌফিক এম সেরাজ বলেন, আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি তখন তো রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ধারণাটি তেমন প্রচারই পায়নি। ৩০ বছরের ব্যবধানে আজ রিয়েল এস্টেট একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা অনেক বড় একটি বিষয় বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে গত দশকের শুরুতে আবাসন ব্যবসার দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। সামনের দিনে আরো উন্নতি হবে এটা নিশ্চিত।
তৌফিক এম সেরাজের জন্ম ১৯৫৬ সালে ঢাকার আজিমপুর কলোনিতে। গ্রামের বাড়ি পাবনার আতাইকুলা। বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। মা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক। পড়াশুনা ঢাকার গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল ও ঢাকা কলেজ। এরপর বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্স-মাস্টার্স। অনার্স ১৯৭৯ সালে। মাস্টার্স শেষ হয় ১৯৮২ সালে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এরপর ১৯৮৩ সালে কমনওলেথ স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডের লিভারপুল ইউনিভার্সিটিতে যান। পিএইচডি করেন আরবান প্ল্যানিং বিষয়ে। তারপর পিএইচডি শেষে ১৯৮৭ সালে দেশে এসে এক বছরের মতো বুয়েটে শিক্ষকতা করে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করার পর থেকে দুই মাসের মধ্যেই শেলটেক শুরু।
সেরাজ বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করব এ ধরনের মানসিক একটা প্রস্তুতি আগে থেকে ছিল। তবে এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। পরিবারের কেউই আমার ব্যবসার সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করেনি। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে থাকি। আর একটু একটু করে সাফল্য আসতে থাকে। শিক্ষকতা ছাড়ার পিছনে একটি কারণ ছিল, প্রতিদিন একই কাজ- একই জায়গা ভালো লাগত না। তবে শিক্ষকতা খারাপ লাগতো না। এখনো মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ক্লাস নেই। কিন্তু সারাজীবন একই গণ্ডির মধ্যে থাকাটা আমার কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল না। আমার স্ত্রী, মা, বোনের স্বামী, ছোট ভাই, পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই শিক্ষকতায় ছিলেন- আছেন। কিন্তু আমি শুধু ব্যতিক্রম।
তিনি বলেন, এর পাশাপশি কনসাল্টিংয়ের কাজ করি। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই কনসান্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৮ সালের প্রথম দিক থেকেই কনসালন্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত। কনসাল্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বড় একটা উইং আছে। এ ক্ষেত্রে শেলটেক একটি ইউনিক কোম্পানি। কিন্তু আমাদের মূল ব্যবসা যেহেতু অন্যটা, তাই ঠিক টাকা কামানোই কনসাল্টিংয়ের ক্ষেত্রে আবশ্যক মনে করি না। আমার ব্যবসায় আমার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশি প্রেরণা দিয়েছে তাহলো অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বা স্বাধীনতার বিষয়টা আমার পছন্দের ছিল। খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। আর একটি সৎ মধ্যবিত্ত পরিবারে সব সময়ই টাকা-পয়সার একটা হিসাব-নিকাশ, টানাটানি থাকতই। এটাই স্বাভাবিক ছিল।
নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে সেরাজ জানান, আমাদের মূল ব্যবসা আবাসন খাতে। বাংলাদেশে যে কয়টি কোম্পানি প্রথম দিকে আবাসন শিল্পে পদার্পণ করে আমরা তাদের একটি। আমরা ’৮৮-এর শেষ দিকে যাত্রা শুরু করি। নব্বইয়ের দশকে ১০-১২টার বেশি মানসম্মত কোম্পানি ছিল না। রিয়েল এস্টেট ব্যবসার প্রসারটা হয়েছে মূলত নব্বইয়ের দশকের পর থেকে।
শেলটেক প্রতিষ্ঠায় আমরা দু’জন ছিলাম। আমি এবং ছোটবেলার বন্ধু কুতুবউদ্দিন আহমেদ। ক্লাস থ্রি থেকে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করছি। সেই থেকে একই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে আজ পর্যন্ত একইসঙ্গে ব্যবসা করছি। প্রথম প্রজন্ম হিসেবে ব্যবসায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তাই সবার মধ্যে অনীহা ছিল। এমনটা থাকাই স্বাভাবিক বলে আমার মনে হয়। কারণ মোটামুটিভাবে নিশ্চিত একটা ক্যারিয়ার ছেড়ে ব্যবসায় যাওয়া সহজ নয়।
শেলটেকের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর আমি উচ্চশিক্ষায় মনোযোগ দিই। কুতুব তখন বেসরকারি চাকরিতে ঢোকে। এর কিছুদিন পর কুতুব গার্মেন্ট ব্যবসার উদ্যোগ নেয়। সেটাও আমাদের দেশের প্রথম দিকের গার্মেন্ট ব্যবসা। আমি ’৮৭ সালে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফেরার পর কুতুবের ব্যবসা দেখতাম। কথাবার্তা বলতাম। কি ব্যবসা করা যায় সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা হতো। আমি চিন্তা করতাম আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো ব্যবসার। রিয়েল এস্টেট বা অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা বিষয়ে কথা হতো দু’জনের মধ্যে। নতুন ব্যবসা হিসেবে এবং আমার পছন্দের সঙ্গে মিল থাকায় আমরা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম যে রিয়েল এস্টেট ব্যবসাই করবো।
অর্থায়ন নিয়ে তিনি বলেন, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করতে গেলে প্রথমেই পুঁজির দরকার। ততদিনে কুতুব কয়েক বছর ব্যবসা করে কিছু পুঁজি দিতে পারলো। সেই সঙ্গে নতুন ব্যবসার বিষয়টি শেয়ার করলাম পারিবারিক বন্ধু স্কয়ার গ্রুপের স্যামুলেস চৌধুরী ও তপন চৌধুরীর সঙ্গে। তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলো। এভাবেই প্রাথমিক পুঁজি পাই তিন বন্ধুর কাছ থেকে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা তখন আমাদের দেশে প্রথম। তাই ব্যবসা শুরুর সময় থেকেই ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। খুব যে চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে বিষয়টা তেমন না। তবে অনেক বিষয়ে সমস্যা ছিল। যেমন- নতুন এ ব্যবসার কোনো নিয়মনীতি ছিল না বললেই চলে। তার ওপর সাধারণ মানুষকে নতুন ধারণা সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে, বুঝিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ১টি ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে যে কষ্ট বা ধাপগুলো পার হতে হয় সেগুলো আমাদের করতে হয়েছে। তবে আমরা তুলনামূলক ভালো সাড়া পেয়েছি। কারণ প্রথম থেকেই আমাদের একটি পেশাদারিত্ব ছিল। যে কারণে মানুষ আস্থা রেখেছে এবং দিন দিন আস্থা বেড়েছে। আর এ কারণে শেলটেক আজকের জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। সততা, গুণগত মানের নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ই আমাদের ফাউন্ডেশন গড়ে দিয়েছে, যা আজ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে শেলটেককে একটা সত্যিকার করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চাই। আমরা যে অবস্থানে এসেছি, এতে আমরা তৃপ্ত। তবে আজকের নতুন সময়ে এসে প্রতিষ্ঠানকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে হবে। এজন্য নতুনদের কাজ করতে হবে। বলবো না যে আমরা শতভাগ করপোরেট হতে পেরেছি। তবে সেই ধারাবাহিকতায় আমরা আছি বলে মনে হয়।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031