প্রধান ‍বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রাজধানীর হাজারীবাগ থাকা ট্যানারি সরিয়ে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে নেয়ার পর যেন ধলেশ্বরী নদীর একই দশা না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ট্যানারি স্থানান্তর করে যদি ধলেশ্বরীর একই দশা হয়, তাহলে তো এই উদ্যোগের মানে হয় না।

নির্ধারিত সময়ে হাজারীবাগ থেকে চামড়া কারখানা না সরানোয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে করা জরিমানা মওকুফ করে রবিবার এক আদেশে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। তিনিসহ চারজনের আপিল বেঞ্চ রবিবার এই আদেশ দেয়া হয়।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে এরই মধ্যে হাজারীবাগে ট্যানারির বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এ কারণেই সেখানে সব কারখানা স্থানান্তর করা যায়নি।

হাজারীবাগের কারখানাগুলো তাদের বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলতো। এ কারণে ঢাকার প্রধান নদীতে বিভিন্ন এলাকায় অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যে নেমে আসে। নষ্ট হয় প্রতিবেশ ও পরিবেশ। এ জন্যই সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাসহ একটি চামড়া শিল্পনগরী করার উদ্যোগ নেয় সরকার।

যেসব কারখানা হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীকে স্থানান্তর হয়েছে, সেগুলো সেখানকার ধলেশ্বরী নদীতে দূষণ ছড়াচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই প্রেক্ষিতেই প্রধান বিচারপতি এই সতর্কতা দিলেন।

বুড়িগঙ্গা বাচাতে গিয়ে ধলেশ্বরীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমার কাছে যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যায়, সাভারে ট্যানারি শিল্প নগরের জন্য ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্লান্ট এখনো চালু হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এখানে বুড়িগঙ্গা রক্ষা করতে গিয়ে ওখানে ধলেশ্বরীর যাতে ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করে দিলাম। ধলেশ্বরীতে যেন ট্যানারিগুলোর বর্জ্য না যায়। তা কঠোরভাবে লক্ষ্য রখতে হবে। এখান থেকে গিয়ে ওখানে আরো একটি নদী যদি দূষিত করা হয় তাহলে গিয়ে লাভ কি?’।

গত ১২ মার্চ হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তর না হওয়া ট্যানারিগুলোর কার্যক্রম বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে করা আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৬ মার্চ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সেলিমের ডিভিশন বেঞ্চ এক আদেশে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি ট্যানারি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হয়।

৩১ মার্চের মধ্যে ট্যানারি শিল্প কারখানা সরিয়ে নিতে সরকার নতুন করে যে সময়সীমা দেয়। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে বেলা।

জরিমানা মওকুফ

সময় মতো না সরানোয় পরিবেশগত ক্ষতির জরিমানা হিসেবে ১৫৪ ট্যানারিকে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং প্রত্যেক দিন ১০ হাজার টাকা করেছিল আপিল বিভাগ। গত ২ মার্চ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের এই বকেয়া টাকা জমা দিতে বলা হয়।

হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। আবেদনটির উপর শুনানি শেষে গত ১৯ মার্চ চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে। একইসঙ্গে মামলাটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।

তবে ট্যানারি মালিকদের আবেদনের পর এই জরিমানা মওকুফ করে শ্রমিকদের কল্যাণে প্রত্যেক কারখনাকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা করে শিল্প সচিবকে জমা দিতে নির্দেশ দেয় আদালত।

আদালতে ট্যানারি মালিকদের পক্ষে ছিলেন ফজলে নূর তাপস। রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন মনজিল মোরসেদ।

হাজারীবাগের ট্যানারিমালিকদের টালবাহানা

মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ওই আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুরির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট ফের নির্দেশ দেয়। সরকারপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এরপরও ওই এলাকা থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়নি। নতুন করে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগ থেকে যেসব ট্যানারি স্থানান্তর করা হবে না, ওইসব ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031