কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য দলের মধ্যে বিভেদকে চিহ্নিত করেছে । এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তারা বলছেন, এই ধরনের বিভেদ যেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব না ফেলে তাই দলের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হবে। এরই মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।
কুমিল্লায় বৃহস্পতিবারের ভোটে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর কাছে আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমা হেরে গেছেন ১১ হাজার ভোটে। এখানে ২০১২ সালের নির্বাচনে সীমার বাবা হেরেছিলেন প্রায় তিনগুণ ভোটে। ভোটের ব্যবধান অনেকটাই কমলেও আওয়ামী লীগ নাখোশ। দলটি মনে করছে, সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারলে জয় আসা কঠিন কিছু ছিল না।
কুমিল্লায় সীমাকে প্রার্থী করার পরেই তার বাবা আফজল খানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের পুরনো দ্বন্দ্ব কী প্রভাব ফেলে সে নিয়ে কথা হয়। তবে আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী ছিল নারায়ণগঞ্জের ঘটনায়। সেখানেও স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্ব নির্বাচনের আগে মিটে যায়। কুমিল্লাতেও এমনটাই হবে বলে জানিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে ভোটের পরদিন ওবায়দুল কাদের বলেছেন,কুমিল্লায় তারা দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি।
কুমিল্লা আওয়ামী লীগ যে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটে লড়তে পারেনি, সেটি ভোটের দিনই টের পেয়েছিলে ওবায়দুল কাদের। ভোট চলাকালে রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘কোন্দল করে নির্বাচনে দলের ‘অনিবার্য’ বিজয়কে যারা নস্যাৎ করে তাদেরকে রেহাই দেয়া হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের নেত্রীর পক্ষ থেকে পরিষ্কার ম্যাসেজ দিতে চাই, এখন থেকে যে কোনো নির্বাচনে যেখানেই বিদ্রোহ, সেখানেই বহিষ্কার, যেখানেই অপকর্ম, সেখানেই কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সাংগঠনিক ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন চলতে থাকবে।’
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, কুমিল্লায় দ্বন্দ্ব নিয়ে কঠোর না হলে এর প্রভাব আগামী সংসদ নির্বাচনেও পড়বে। আর কুমিল্লা ছাড়িয়ে তা অন্য অনেক এলাকায় গিয়ে পৌঁছবে।
মার্চেই ১১টি উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে তিনটিতে আওয়ামী লীগ হেরেছে যার প্রতিটিতেই বড় ব্যবধানে জয় আসতে পারতো। এর প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগর দুই জন করে লড়েছেন এবং তাদের সম্মিলিত ভোট বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এই নির্বাচনের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বিদ্রোহী তিন প্রার্থীকে ছেটে ফেলে দল।
তবে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের ভেতরের বিরোধিতা প্রকাশ্য ছিল না। কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়নি। তাই তিন উপজেলায় যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেখানে এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন যে এলাকা নিয়ে গঠিত, সেটি দুটি সংসদীয় আসনে পড়েছে। এর একটির সংসদ সদস্য হলেন কুমিল্লা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং অপরটির আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। সিটি নির্বাচনে এই সংসদ সদস্যের অনুসারীরা সেভাবে সীমার পক্ষে কাজ করেনি বলে আওয়ামী লীগের মূল্যায়নে উঠে এসেছে। দুই সংসদ সদস্যের প্রভাবিত এলাকা হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রগুলোতে সীমা ভোট কম পেয়েছেন নয় হাজার।
ভোটের ফল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরই আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন দলীয় নেতারা। এতে উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সম্পাদকমণ্ডলীর বেশ কয়েকজন নেতা। এই বৈঠকেই বাহারের বিভিন্ন অসহযোগিতার কথা উঠে আসে।
বৈঠকে কুমিল্লা ঘুরে আসা একজন নেতা তার মূল্যায়ন তুলে ধরেন এভাবে-‘বাহার উদ্দিন কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য যতটা সক্রিয়া ছিলেন, মেয়র-প্রার্থীর জন্য ততটাই বিপরীত অবস্থানে ছিলেন।’
বৈঠকে একজন নেতা এমনও বলেন, ‘এই পরাজয়ের পেছনে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও কিছুটা দায়ী। নির্বাচনে জেতার জন্যে তার সমর্থকদের যতটা সক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল, তিনি ততটা সক্রিয় হননি।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য (বাহার) এখানে বিরোধিতা করেছেন, সেটা সবাই বলছে, আমাদের পর্যবেক্ষণও তাই। তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে আমাদের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছে, আমাদের প্রার্থীর সমর্থকদেরকে নানাভাবে ডিস্টার্বও করার চেষ্টা করেছে। সকালে ছয়টি কেন্দ্রে আমাদের কোনো এজেন্ট ছিল না। এগুলো আমরা কেন্দ্রকে জানবো। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আওয়ামী লীগের একজন সম্পাদকমণ্ডলীর আরও একজন সদস্য বলেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন পরাজয়কে স্থানীয় নেতাকর্মীরা স্থানীয় দুই সংসদ সদস্যের অসহযোগিতাকে দায়ী করছে। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে। সেই বিষয়ে আমাদের দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। তারপর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’ সেটা কি ধরণের হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে এই নেতা বলেন, ‘সাংগঠনিক যে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, তাই নেয়া হবে ।’
নৌকা মার্কার প্রার্থী সীমার পিতা ভোটের ফলাফলের পর প্রকাশ্যেই দলের ভেতরের ‘বেইমানি’কে তার মেয়ের হারের জন্য দায়ী করেছেন। তবে সীমা এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেননি।
তবে সীমাকে অসহযোগিতার কথা অস্বীকার করেছেন বাহাউদ্দিন বাহার। তিনি বলেন, ‘‘আমার কারণে রেজাল্ট খারাপ হয়নি। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নির্বাচনী এলাকার নয়টি কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রে পাস করেছে। আমার এলাকার আঠারোটি ওয়ার্ডের অনেকগুলো কেন্দ্রে আমরা পাস করেছি।’ ‘তিনি বলেন, ‘কষ্ট করে পাস করাইতে কাজ করেছি। এখন ফেল করার পর বলা হচ্ছে আমার দোষ।’
তবে এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘যারা দলের মধ্যে থেকে দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কাজ করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কুমিল্লার বিষয়ে ইতোমধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকদের বলেছি এ বিষয়ে তথ্য নিয়ে আসতে। এরপর আমরা সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেবো।’