কোনো গাড়ির সামনে-পেছনে দুমড়ে আছে, যেন কোনো দুর্ঘটনা থেকে মাত্রই উদ্ধার করে আনা হয়েছে গাড়িটি। কোনো গাড়ি জীর্ণ, সামনের কাচ নেই, বাতি নেই। অনেক গাড়ির কাঠামো রংচটা, তুবড়ানো, নির্দেশক বাতিহীন, যেন এটাই স্বাভাবিক। এমন হাজার হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি অবাধে চলছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।
সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে এই মহানগরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ১৬ হাজার। এসব গাড়ির কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে এখানকার গণপরিবহন ব্যবস্থা।
ফিটনেসবিহীন গাড়ির মধ্যে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানই বেশি বলে জানান বিআরটিএ সূত্র। কোনো কোনোটি নিবন্ধনের পর আর ফিটনেস সনদ নেয়নি। পাঁচ-সাত বছর ধরে ফিটনেস সনদ নেওয়া হয় না এমন যানবাহনও রয়েছে। ব্যক্তিগত কিছু গাড়ির মালিকও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফিটনেস সনদ নেন না; যা ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকায় চলে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশলী অধ্যাপক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, যানবাহনে দিকনির্দেশক (ইন্ডিকেটর) লাইট দিয়ে এক চালক অন্য চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে অনুযায়ী চালক ব্রেক কষে কিংবা হুইল ঘোরান। এর একটা ত্রুটিপূর্ণ হলেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
শাহরিয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘সামান্য একটা ওয়েফার (গ্লাস মোছার সরঞ্জাম) না থাকার কারণেও গাড়ি বৃষ্টি বা কুয়াশায় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। টায়ার ফেটে গিয়ে দুর্ঘটনা হয়। গাড়ির আকৃতি পরিবর্তন দুর্ঘটনার বড় কারণ। এর সব কটিই ফিটনেসের সময় নিশ্চিত করার কথা।’
বিআরটিএর হিসাব মতে, চট্টগ্রামে নিবন্ধন নেওয়া যানবাহনের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল। তবে মোটরযান আইনে মোটরসাইকেলের জন্য ফিটনেস সনদের কোনো বিধান নেই। বাকি সব যানের জন্য প্রতিবছর এই সনদ নিতে হয়। কিন্তু সনদ ছাড়াই চলছে ১৬ হাজার যানবাহন।
চট্টগ্রাম যাত্রী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. মুছা বলেন, ‘পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, খালি চোখেই অনুমান করা যায় চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী গণপরিবহনের ৯৫ শতাংশ অনুপযুক্ত। ফিটনেস দেওয়ার পদ্ধতিতে গলদ আছে। সড়কে আইনের প্রয়োগও কম।’ তিনি বলেন, গলদ সারতে সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে।
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বড় অংশ চলছে চট্টগ্রাম মহানগর এবং এর আশপাশে। আর কিছু চলছে দূরের পথে। বিআরটিএ সূত্র জানায়, এগুলোর একটিও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে ফিটনেস পরীক্ষা হয়নি। বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা চোখে দেখে ফিটনেস পরীক্ষা নেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে শুরু হয় যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা। সূত্র জানায়, গত অক্টোবর থেকে দুই হাজারের বেশি বাস-ট্রাক পরীক্ষা করা হয় যন্ত্রে। প্রথম দিকে অর্ধেকই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়। মোটরযান আইনে, মেয়াদোত্তীর্ণ না হলে ফিটনেস সনদ পরীক্ষায় ব্যর্থ যানবাহনকে ত্রুটি সারিয়ে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) নামের এই যন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম চালু করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ পাঁচটি বিভাগীয় কার্যালয়ে এসব যন্ত্র বসানোর পরপরই বিকল হয়ে যায়। এবার দক্ষিণ কোরিয়ার অনুদানে প্রায় ২২ কোটি টাকায় মিরপুরে পুনরায় যন্ত্র বসানো হয়েছে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে লক্ষাধিক যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই যেমন সত্য, তেমনি যেসব যানের সনদ আছে, যন্ত্রে পরীক্ষা হলে সেগুলোর একটা বড় অংশই চলাচলের উপযুক্ততা হারাবে।
মোটরযান আইন বলছে, যানবাহনের ফিটনেস সনদ পাওয়ার মূল শর্ত হলো কারিগরি ও বাহ্যিকভাবে চলাচলের উপযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের ৬০টির মতো কারিগরি ও বাহ্যিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এসব বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গাড়ির ইঞ্জিনের পুরো কার্যকারিতা, আকৃতি ও নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা ওজন ঠিক আছে কি না। দেখতে হবে কালো ধোঁয়া বের হয় কি না এবং ব্রেক, লাইট ও বাহ্যিক অবয়ব ঠিক আছে কি না। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার নিয়ম।
সড়ক ও পরিবহন কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলার পেছনে বিআরটিএর একশ্রেণির কর্মকর্তা দায়ী। তারা ঘুষ নিয়ে অনেক সময় যানবাহন না দেখেই সনদ দিয়ে দেন। এ ছাড়া সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দিকে অভিযোগের আঙুল ওই কর্মকতার। তার মতে, পুলিশ সড়কে কঠোর অবস্থান নিলে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল কমে যাবে।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক মো. শহিদ উল্লাহ বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন পরীক্ষার জন্য রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও এ অভিযান শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। যেনতেনভাবে লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন যাতে সনদ না পায়, সে জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসানোর কাজ চলছে বলে জানান তিনি।