সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের কোনো শেষ নেই। রাজধানীতে পরিবহনের শৃঙ্খলা এবং ভাড়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে―এমন প্রমাণ নেই। বাস থেকে অটোরিকশা সবকিছুতে মালিকপক্ষের ইচ্ছাই শেষ কথা। এতে করে ঠকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
মিটার ছাড়াই চলা, অতিরিক্ত ভাড়া দাবি এবং যাত্রীর ইচ্ছানুযায়ী গন্তব্যে যেতে অনীহা- সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সড়কে সড়জে অটোরিকশা চালকদের রামরাজত্ব চলছে। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো এখানে।
অকেজো অটোরিকশার মিটার
গণপরিবহন হিসেবে বাসের বাইরে ঢাকাবাসীর আরেক বিড়ম্বনার নাম সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কেউ যেন মিটারের ভাড়া ছাড়া যাত্রী না নেয় তার জন্য ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানো হয়। মাস কয়েক এর সুফলও পেয়েছে যাত্রীরা।
তখন খুশি হয়ে কিংবা চালকের আবদারে ১০-২০ টাকা বখশিশও দিয়েছে তারা। এখন আবার অটোরিকশা চালকরা সেই পুরোনো নৈরাজ্যে ফিরে গেছেন। মিটারের বদলে চলছেন দাবি-দাওয়ার ভাড়ায়। মিটারে গেলেও বখশিশের নামে ৩০-৫০-১০০ টাকা বাড়তি দাবি করছেন। নাখোশ যাত্রীদের কেউ বিপদে পড়ে মেনে নিচ্ছেন।
কেউ আবার চুক্তির ভাড়ার সঙ্গে মিটারের ভাড়ার বিশাল ফারাক দেখে অটোরিকশায় না উঠে চালকের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ বাড়তি ভাড়ার জন্য চালকদের এককভাবে দায়ী করার উপায় নেই। কারণ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিকরা। তারা নির্ধারিত টাকার চেয়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত ‘জমার টাকা’ আদায় করছেন। আবার যানটি দুই বেলা দুই চালকের কাছে দিচ্ছেন।
অথচ বছরখানেকের বেশি সময় আগে অটোরিকশার মিটারের ভাড়া যখন বাড়ানো হয়েছিল তা নিয়েও যাত্রীদের আপত্তি ছিল না। কারণ মিটার কার্যকর হলে চুক্তির বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাবেন তারা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যও তখন ছিল বেশ আশাজাগানিয়া।
কারণ তিনি সেই সময় বলেন, চালকরা সিএনজি অটোরিকশায় মিটার না লাগিয়ে চালাতে পারবে না। যাত্রী যেখান থেকে যেখানে যেতে চায় তারা সেখানে যেতে বাধ্য থাকবে। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিকরা বেশি অর্থ জমা নিতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে এগুলো এখন আর কার্যকর নেই।
মশিউর রহমান শাহবাগ থেকে যাবেন রামপুরা ব্রিজে। এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে ডাকলেন। শুরুতেই সেই চালক সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন মিটারে যাবেন না। চুক্তিতে ভাড়া কত? জানতে চাইলে চালক দাবি করলেন, ৩০০ টাকা। মশিউর যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কারণ মিটারে ভাড়া শ-খানেক টাকার বেশি ওঠার কথা না। তাই তাকে এ অটোরিকশার আশা ছাড়তেই হলো। কিন্তু অন্য কয়েকজন চালক যেতেই রাজি হলো না। শেষ পর্যন্ত বিকল্প যানবাহনের চিন্তা করতে হলো। অথচ একটু দ্রুত যাওয়ার তাড়া ছিল মশিউরের।
গুলশান থেকে উত্তরায় মিটারে যেতে চাইলে অটোরিকশাচালক মজিবর বলেন, ‘আমি মিটারে যাই না, চুক্তিতে গেলে উঠেন।’ মিটারে গেলে সমস্যা কোথায়, জানতে চাইলে এ চালক বলেন, ‘মিটারে গেলে সংসার চলব কেমন কইরা?’ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, মালিকের দৈনিক ভাড়া বাড়ানো, এসব কারণে দিন শেষে খুব একটা আয় করা যায় না বলে দাবি করলন মজিবুর। তাই চুক্তিতে গিয়ে আয় বাড়িয়ে নিতে চান।
তবে নতুন ভাড়া কার্যকরের পর যানজটে পড়লে মিটারে গেলে যাত্রীদেরও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এ প্রসঙ্গে অটোরিকশাচালক জাকির হোসেনের অভিযোগ, ‘যাত্রীরাই এখন মিটারে যেতে চায় না। জ্যামে পড়লে তাদের বেশি বিল দিতে অয় এর লাইগা। মিটারে গেলে আমাদের বেশি পোষায় না তারপরও মিটারে যাই।’
মিটারে না গেলে ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়তে হতে পারে, এই ভয়ও থাকে চালকদের। তাই চুক্তির ভাড়ার সময়ই তারা মিটার চালু করেন। আর যাত্রীদের বলে দেন, যাতে ট্রাফিক সার্জেন্টকে তারা বলেন মিটারে যাচ্ছেন।
আবার কোনো কোনো চালক মিটারে যাওয়ার বিষয়ে রাজি হলেও তারা দূরত্বের ভিত্তিতে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বখশিশ দাবি করেন। মিটারে গেলেও কোনো কোনো চালক সহজ রাস্তা বাদ দিয়ে অনেক দূর ঘুরিয়ে যাত্রীকে গন্তব্যে নেন। এতে মিটারে গিয়েও যাত্রীকে বেশি ভাড়া মেটাতে হয়। অথচ চুক্তিকে গেলে একই গন্তব্যে চালক দ্রুত সহজ রাস্তায় চলে যান।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি নিয়ে অটোরিকশাচালকদের কেউ কেউ ভয়ে আছেন। এ প্রসঙ্গে যাত্রাবাড়ীর চালক মনু মিয়া বললেন, ‘অবরোধের দুই দিন যাত্রীরাই তিন-চাইর গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাইতে চাইছে। অনেকে অনেক টাকা কামাইছে। কিন্তু আমি বাইর হয় নাই। কারণ পাবলিকে কখন খেইপা গিয়ে গণপিটানি দেয় তার কোনো ঠিক নাই।’
আরেক চালক কৃষ্ণ রায় বললেন, ‘গাড়ির জমা দিই ৯০০ টাকা। তা-ও আমার গাড়ি পুরান, তাই কম দিই। নতুন গাড়ির জমা এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা। তারপর অনেক গাড়ির কাগজ ঠিক না থাকায় রাস্তায় পুলিশ ধরলে টাকা-পয়সা দিয়া ছাড়ায়া নিয়া আসতে হয়। রাস্তায়ও থাকে জ্যাম, তাই বেশি ট্রিপ নিতে পারি না। মিটারে চললে দিন শেষে যেই টাকা আসে, তা দিয়ে নিজেই চলতে পারি না।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় তালিকাভুক্ত অটোরিকশা ৯ হাজার ১৩টি। তবে নগরের রাস্তায় এর বেশি আছে তিন চাকার এই যান। এর মধ্যে প্রাইভেট নামধারী কিছু যান ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে। আবার ঢাকার জেলার নিবন্ধন পাওয়া অটোরিকশাও ঢাকা শহরে চলাচল করছে। এই অবৈধ অটোরিকশা চলাচলের পেছনে প্রভাবশালী মহলের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। যাদের কেউ কেউ আবার সড়কে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন।
ভোগান্তির তথ্য জানান
সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের হয়রানি আর বিড়ম্বনার কথা কাকে জানাবেন, অনেকেই জানেন না সেই কথা। অথচ এ ধরনের ভোগান্তির কথা চিন্তা করেই বিআরটিএ অসাধু চালক আর অটোরিকশা মালিকদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য একটি ক্ষেত্রে তৈরি করছে।
এজন্য অভিযোগ করতে বিআরটিএর ওয়েবসাইটের এই লিংকে : http://www.brta.gov.bd/newsite/en/complain-queries/। এখানে ভিজিট করলেই অভিযোগ ও অনুসন্ধান পাতা আসবে, যেখানে নিজের তথ্য ও অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণসহ প্রয়োজনীয় ছবি সংযুক্ত করা যায়।
বিআরটিএ বিষয়টি আমলে নিয়ে সাত কার্যদিবসের মধ্যে শুনানির জন্য ডেকে পাঠাবে তাদের অফিসে। শুনানিতে যথোপযুক্তভাবে অভিযোগ তুলে ধরতে পারলেই দোষী চালক ও মালিককে জরিমানা করা হয়ে থাকে। শাস্তির বিধান অনুযায়ী উভয়েরই লাইসেন্স বাতিলও হয়ে যেতে পারে।