ঐতিহাসিক জয়, ঐতিহাসিক টেস্টে। শঙ্কা-সংশয়, আর নয়, আর নয়- বাংলাদেশ দল যেন এক সুরে গেয়ে উঠলো। আনন্দে উদ্বেল গোটা দেশ। শঙ্কা কাটিয়ে লঙ্কা জয়। মাত্র ছ’মাস আগে যে মাটিতে বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়া হোয়াইটওয়াশ হয়ে ফিরেছে সেখানে সেই দলের বিপক্ষে জয়- সিংহল দ্বীপ কেঁপে ওঠারই কথা। সিংহের ডেরায় বাঘের আঘাত। স্বাধীনতার মাস, জয় বাংলা সিরিজ। কী জানি কী হয়। গল টেস্টে হারের পর পিছু ছাড়েনি শঙ্কা। তবে দেশের শততম টেস্টে অন্যরকম এক সংকল্প ছিল ক্রিকেটারদের মধ্যে। মাইলফলকের এ টেস্টের আগে দল নিয়ে খানিকটা মান-অভিমানও চলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতির উপস্থিতি আর হস্তক্ষেপে এক টেস্টেই চার পরিবর্তন। মাহমুদুল্লাহ-মুমিনুল বাদ। সৌভাগ্যবান মোসাদ্দেকের অভিষেকের সঙ্গে দলে ঢুকে যান চোটের কারণে বাদ পড়া ইমরুল কায়েস। বোর্ড প্রধানের সাফ কথা-কে এলো আর কে গেল তা দেখার সুযোগ নেই। জয় চাই-ই। আওয়াজ চারদিকে। সাফল্যে সার্থক হলো ব্যাটে-বলের লড়াই। সব ভুলে আজ এক কাতারে বাংলাদেশ।
মেহেদী হাসান মিরাজের ঠেলে দেয়া বলটা যখন শ্রীলঙ্কান ফিল্ডারদের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল তখনই কেল্লা ফতে। মান-অভিমান ভুলে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন এক সারিতে। দু’রান দরকার। কিন্তু অধিনায়ক মুশফিক প্রথম রানই নিলেন নিশ্চিত ম্যাচ জয়ের আনন্দে ব্যাট উঁচিয়ে। পরের রানটাও হয়ে গেল সহজেই। ব্যবধান মাত্র চার উইকেটের। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরদিন জ্বলজ্বল করবে শততম টেস্টে জয়ী বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে তো বটেই, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই বাংলাদেশের প্রথম জয় এটি। দেশের বাইরে বাংলাদেশের সামর্থ্যের প্রমাণের সূচনা যেন এই টেস্ট জয়। এ বছর নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও পারেনি বাংলাদেশ। ভারতের মাটিতেও লড়াইটা মন্দ করেনি সাকিব-মুশফিকরা। অবশেষে জয় ধরা দিলো শ্রীলঙ্কায়।
দেশের বাইরে বাংলাদেশের এটি মাত্রই চতুর্থ টেস্ট জয়, সব মিলিয়ে ৯টি। ১০০ টেস্টের মধ্যে এর চেয়ে কম জয় কেবল নিউজিল্যান্ডের-৭টি। শততম টেস্টে জয়ের আনন্দটা আলাদাই। যেখানে এমন মাইলফলকের ম্যাচে আগে জয় ছিল কেবল অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তানের। ২০০১ থেকে ২০১৭ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে খেলা ৪৭ টেস্টে চতুর্থ জয়। ২০০৯-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুই জয়ের পর জিম্বাবুয়েতে জয় ২০১৩তে। মাঝে তিন বছর পেরিয়ে এলো চতুর্থ জয়। এ যাবৎ বাংলাদেশ সিরিজ খেলেছে ৫১টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে তিনটি আর ড্র করেছে ছয়টি। দেশের বাইরে এটি দ্বিতীয় সিরিজ ড্র। ২০১৩তে জিম্বাবুয়ের মাটিতে প্রথম ড্র-এর পরই এটি। দেশের বাইরে একমাত্র সিরিজ জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২০০৮এ। ২০১৬-১৭ মৌসুমটা যেন বাংলাদেশের ইতিহাস গড়ার মৌসুম।
পঞ্চম দিন চা বিরতির পর বাংলাদেশের লক্ষ্য কমে দাঁড়ায় ৩৫ রান। চার উইকেট হারানোর পর অধিনায়ক মুশফিক আর সাকিব আল হাসান তখন ক্রিজে। জয় নিয়ে সংশয় খুব কমই। তবুও বুক একটু হলেও কেঁপে ওঠে সাকিবের বিদায়ে। লড়াকু লঙ্কানরা যেন শেষ কামড় দিতে মরিয়া। কিন্তু তরুণ মোসাদ্দেক পরিবেশটা হালকা করে দিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিন ডাবল সেঞ্চুরির মালিক ময়মনসিংহের এ তরুণ দুটি চার মেরে বুঝিয়ে দিলেন আমরা আজ হারতে আসিনি। কিন্তু জয় থেকে দুই রান দূরে থাকতে অভিজ্ঞ সেনাপতি রঙ্গনা হেরাথের বলে কট বিহাইন্ড মোসাদ্দেক। লক্ষ্যপূরণে কাজটুকু করেন অনূর্ধ্ব ১৯ দলের সফল অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। ৫৭.৫ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৯১ রান তোলে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে করা ৩৩৮ রানের জবাবে প্রথম ইনিংসে ৪৬৭ রান করে জয়ের সম্ভাবনাটা জোরালো করে বাংলাদেশ। তামিম-সাকিব-মুশফিক-মোসাদ্দেক-সৌম্য ফিফটি করে যেমন অবদানকে উজ্জ্বল রেখেছেন, তেমনি ফিফটি না পেলেও সাব্বিরের ৪২ আর ৪১ রানের ইনিংসের ভূমিকাটা খাটো করে দেখার উপায় নেই। বোলিংয়েও সাকিব-মোস্তাফিজের পাশে মেহেদী হাসান মিরাজের ভূমিকাও উজ্জ্বল।
সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে চৌকস নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যাচসেরা হওয়ার দৌড়ে প্রথম ছিলেন। কিন্তু ঘোষণা আসে তামিম ইকবালের নাম। পরিসংখ্যান নয়, এখানে বিবেচনা আনা হয় দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম ইকবালের সাহসী ব্যাটিং। হেরাথের জোড়া আঘাতে বাংলাদেশ শিবির যখন কম্পমান তখন তামিম আর সাব্বির রহমানের জুটিই দলকে জয়ের পথে অবিচল রাখে। ১০৯ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভাঙে তামিমের বিদায়ে। চট্টগ্রামের ছেলে বাঁ-হাতি ওপেনার তামিম ইকবাল একটু সচেতন হলে সেঞ্চুরিও পেতে পারতেন। কিন্তু তার ১২৫ বলে করা ৮২ রান নিঃসন্দেহে অনেক অনেক মূল্যবান। নিজের ৪৯তম টেস্টের প্রথম ইনিংসেও মন্দ করেন নি তিনি। এক রানের জন্য মিস করেন ফিফটি। তবে উদার তামিম তার পুরস্কারটি বন্ধু সাকিব আল হাসানকেই তুলে দেন তামিম। সাকিব অবশ্য তার নৈপুণ্যের স্বীকৃতি পান সিরিজ সেরার পুরস্কারে।
পুরো পাঁচদিনই ম্যাচের লাগাম ছিল বাংলাদেশের হাতে। মাঝে কিছুটা সময় দোদুল্যমান থাকলেও কাঙ্ক্ষিত জয়টা ছিনিয়ে আনেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কলম্বোর পি সারাভানামুতু স্টেডিয়ামে গতকাল বাংলাদেশ দল চার উইকেটে জয়ী হয়। সমতা আসে সিরিজে। যে ট্রফিটা এতদিন কেবল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের আলমিরাতেই আবদ্ধ থাকতো এবার তা মুক্ত হলো। কাপের অংশীদার এখন বাংলাদেশও। শ্রীলঙ্কায় সিরিজ শেষে প্রতিবারই মুখ গোমরা করে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঙ্কানদের উল্লাস দেখলেন। এবার আর তা হলো না। আনন্দে মাঠ জুড়ে হৈ-হুল্লোড় করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। মুখ ভার ছিল স্বাগতিক খেলোয়াড় আর দর্শকদের।
শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ দলের এ সফরটা ছিল যোগ্যতা প্রমাণের। মাত্র মাস পাঁচেক আগে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর নিন্দুকদের মন্তব্য-দেখা যাবে দেশের বাইরে কেমন? এ জয়ে তাদের মুখটা বন্ধ না হলেও মেপে বলবেন তারা। বাংলাদেশের বোলাররা এবারই প্রথম শ্রীলঙ্কাকে দুবার অলআউট করতে পেরেছে। আর জয়টা সম্ভব হয়েছে এতেই। না হয়, টেস্টের ভাগ্য অমীমাংসিতই থাকতে পারতো।
টেস্ট সিরিজ শেষে এবার অপেক্ষা ওয়ানডে সিরিজের। ২৫শে মার্চ শুরু তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা গতকাল মাঠে থেকেই উদযাপন করেন টেস্ট জয়। ওয়ানডেতে এ জয় বাড়তি প্রেরণা আর শক্তি যোগাবেই। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ওয়ানডে জয়ের প্রতীক্ষাটা ২০১৩ সালে ঘোচে। তবে সেটি ছিল বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ। এবার সরাসরি জয় হতেই পারে।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031