শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে আওয়ামের একজন হয়ে কথা বলার এখতিয়ার কি আছে আমাদের? আমার মনে হয়, শতভাগ আছে। শেখ হাসিনা শুধু একজন ব্যক্তি নন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেঁচে যাওয়া দুই সন্তানের একজন। বঙ্গবন্ধু কন্যা, তার উপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। আবার তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

তিনি সেই প্রধানমন্ত্রী যিনি গত আট বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বাদ দিলেও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ শেখ হাসিনাকে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক মনে করে থাকেন, তার উপর আস্থা স্থাপন করেছেন। বিএনপি-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত উন্নয়নের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন অনেক সময়।

সব মানুষেরই জীবনের মূল্য আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার জীবনের মূল্য সাধারণ কোনো মানদণ্ডে মাপা যাবে না। একজন সাধারণ বাবা/মা মারা গেলে পরিবার হুমকির মধ্যে পড়ে। কিন্তু শেখ হাসিনার মত মানুষের কিছু হলে পুরো রাষ্ট্র হুমকির মধ্যে পড়বে। তিনি পুরো রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাই শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কেউ ভাবতে পারেন, আমি শেখ হাসিনার বন্দনা শুরু করেছি। বিশেষ করে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জন্য এভাবে একজন ‘দলীয় প্রধান’ এর বিষয়ে এভাবে লেখালেখি করা অনেকের কাছে ‘আপত্তিকর’ মনে হতে পারে। কিছু করার নেই। কে কী ভাবল, সেটা নিয়ে চুপ করে থাকার মানে হয় না। আওয়াজ তুলতে হবে। শুধু শেখ হাসিনা কেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ হিসাবে জীবিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে খালেদা জিয়ারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, খালেদা জিয়াকে কি একবারও কি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হয়েছে? সবসময় কেন শেখ হাসিনাই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন? অনেক কারণ।  একে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যা করতে চায়। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর পরে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে কার্যকরভাবে বাংলাদেশকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে খ্যাত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে উন্নয়নের একটা নির্দিষ্ট পথে ধাবিত করতে পেরেছেন।

বিএনপিও ক্ষমতায় ছিল। তাদেরও উন্নয়ন সাফল্য আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যের সঙ্গে তুলনীয় নয় বলেই আমার ধারণা। চাইলে কোনো অর্থনীতিবিদ তুলনামূলক গবেষণা করে দেখতে পারেন। আমার হাইপোথিসিস প্রমাণিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে কোনো ঘটনা/দুর্ঘটনা কিংবা আলোচনা বাড়তি গুরুত্বের দাবি রাখে।

নিরাপত্তার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। বিশেষ কারণ আছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার সান্তাহার স্টেডিয়ামে, গত রোববার। শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দিয়ে মঞ্চ থেকে নামছিলেন। সাথে নিশ্চয়ই তাঁর এডিসি ছিল, এসএসএফের কর্মকর্তারা ছিলেন। ব্যক্তিগত উইং এর লোকজনও ছিলেন, অবশ্যই। নামার সময় এক নারী প্রায় লাফ দিয়ে শেখ হাসিনার কাছে চলে যান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী নিজে হকচকিয়ে যান। অবশ্য সাথে সাথে তিনি বরাবরের মতই বিচক্ষণতার সঙ্গে বিষয়টা মোকাবেলা করেন। লাফ দিয়ে গায়ে পড়া সেই নারীর সঙ্গে দুয়েকটা কথা বলে শেখ হাসিনা তাঁর গাড়িতে গিয়ে উঠেন। পুলিশ পরে সেই নারীকে জেরা করে।

পরে জানা যায়, সবাইকে চমকে দেয়া সেই নারীর নাম ফারহানা মল্লিক। এই নারী নিজেকে নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই নারীকে ‘ছলছল’ চোখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কী যেন বলতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীও দুই একটা কথা বলে নিরাপদে কিন্তু আমার ধারণা ‘মহাবিরক্ত’ হয়ে গাড়িতে উঠেছেন।

প্রথম কথা হল, লাফ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গায়ে পড়া এই নারী কে? এখনকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে কোনকিছুই গোপন থাকে না। এমন সব বিষয় সামনে এসেছে যা পাবলিকলি শেয়ার করা যাবে না। ফারহানা হায়দার নামে তিনি একটা ফেসবুক আইডি চালান। সেখানে নিজের পরিচয় দিয়েছেন, ‘ম্যানেজিং মেম্বার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’!

দুইটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। একটা এনজিওর কর্ণধারও তিনি। আমি ছবি তুলে রেখেছি। প্রোফাইল চেইঞ্জ করে লাভ নাই। আবার লিখেছেন, তিনি ‘জয় বাংলার লোক’। যুবলীগের সঙ্গেও তিনি রাজনীতি করেন বলে দাবি তার। আমার ইনবক্সে একটা স্ক্রিন শট আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ফারহানা হায়দার নিজের সাথে খালেদা জিয়ার মিল খুঁজে পান, তাই তিনি বিএনপির রাজনীতি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আরেকটু গভীরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ফারহানা হায়দার বা ফারহানা মল্লিক এর বাড়ী কুড়িগ্রাম। স্বামীর বাড়ী বগুড়া, নাম সাখাওয়াত মল্লিক। বর্তমান ঠিকানা ঢাকার লালমাটিয়া।
স্বামী সাখাওয়াত মল্লিক নাকি খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়ার একসময় বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন (এখনো থাকতে পারেন)। মল্লিক সাহেব একজন বিত্তবান মানুষ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকারে আসলে মল্লিক তার স্ত্রী ফারহানা হায়দারকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ফারহানা পরে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হন। এমনকি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও পরিচয় আছে বলে প্রতীয়মান। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এই ফারহানা ওবায়দুল কাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।

খবরে এসেছে ফারহানা শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সময় কান্না করছিলেন! কী তার দুঃখ? সাধারণত গরিব মানুষ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানদের পেলে এমন করেন। তাহলে ফারহানা সেদিন এমন লাফ দিয়ে পড়লেন কেন?

এখন আসি আলোচনার অন্য প্রেক্ষিতে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে, মূল মঞ্চের সামনে কারা কারা যেতে পারে? এসএসএফ, পিজিআর, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, প্রাসঙ্গিক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, সুনির্দিষ্ট কয়েকজন চিত্র সাংবাদিক। টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে, বসে কাজ সারেন। ক্যামেরা পারসনরাও ইদানিং হাঁটাহাঁটি খুব একটা করেন না। নিরাপত্তার খাতিরে এদেরকেও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। খুবই স্পর্শকাতর একটা পরিবেশ থাকে। অযথা পকেটে হাত দিলে এসএসএফ সন্দেহ করবে, অযথা হাঁটাহাঁটি করলে করবে। হাই তুললে তাকিয়ে থাকবে। মোটকথা সাধারণের হেন কোন মুভমেন্ট নাই যে এজেন্টরা দেখেনা। চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। এর মধ্যে এই নারী ঢুকল কেমন করে। তাকে সেখানে নিয়ে গেল কে? সবই বের করতে হবে।

দুঃখের বিষয় হল, এই নারীকে নাকি পুলিশ পরে ছেড়ে দিয়েছে! ধরে নিলাম, এই নারী শেখ হাসিনার ক্ষতি করতে সেখানে যাননি। যদি ক্ষতি করতে যেতেন, তাহলে? আর এই পর্যায়ের একজন ‘নেত্রী’ শেখ হাসিনাকে লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরার মত কাছাকাছি যাওয়ার মত নৈকট্যে পৌঁছানোর সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখেন?

সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আছেন যারা জীবনে একবারও শেখ হাসিনাকে এত কাছ থেকে দেখা বা কথা বলার সুযোগ পান না। এই নারী কেন, কীভাবে পেলেন?

কয়েকদিন আগেই তো আমরা দেখলাম শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের নাটবল্টু ঢিলা। উড্ডয়নরত অবস্থায় বিমানের জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। জরুরি অবতরণ করতে হয়েছিল। তদন্ত চলছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটিও কম উদ্বেগের নয়। সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা ভাবনা করার অনুরোধ রইল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031