তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন প্রিয় মতামত বিভাগে নিয়মিত লিখছেন। ভারতের সংসদে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের আইনটি সংশোধন করার ফলে সে দেশের কর্তৃপক্ষ চালকবিহীন গাড়ির অনুমোদন দিতে পারবে। চালকবিহীন গাড়ি এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন বর্তমান বিশ্ব সোচ্চার, তখন বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ কী করছে তথ্যপ্রযুক্তিতে! এসব নিয়ে আজ লিখেছেন।

সারা বিশ্বের চালকবিহীন গাড়ি যখন নতুন নতুন সংবাদ তৈরি করছে, তার ভেতর ভারতও সেই পথে এগিয়েছে। তারা সংসদে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের আইনটি সংশোধন করছে, যার ফলে ভারতের কর্তৃপক্ষ চালকবিহীন গাড়ির অনুমোদন দিতে পারবে। সংবাদটি পড়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। মাথায় ঘুরছিল, চালকবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে উবারের বিরুদ্ধে গুগলের বিশাল মামলার কথা। কিন্তু ভারতের এই নতুন উন্নয়নের সংবাদটি পড়ে কিছুটা হতাশাই এসে ভর করল যেন।

সংবাদটি আমাদের জন্য তেমন কোনও ভূমিকা বহন করে না। ভারতে চালকবিহীন গাড়ি চলবে, নাকি আকাশ দিয়ে গাড়ি চলবে- তাতে আমাদের কী! কিন্তু যেই বিষয়টি আমাকে ভাবায় তা হলো- আমরা কি মন-মানসিকতায় গত শতাব্দির চেয়ে তেমন একটা এগিয়েছি? গত শতাব্দির সবচে বড় কৌতুক ছিল, আমরা বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবল নেইনি। তার কারণ ছিল- আমাদের সব তথ্য বাইরে চলে যাবে। এই ২০ বছর পরে এসেও কি আমাদের সেই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে?

ভারত যা করছে: চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে গুগল, উবার, টেসলা এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ভারতের রাস্তায় যেন এই ধরনের গাড়ি তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারে এবং একটা সময়ে গিয়ে সত্যি সত্যি গাড়ি বানাতে এবং চালাতে পারে, তার জন্য আইন সংশোধন করছে ভারত সরকার। সড়ক পরিবহন মন্ত্রনালয় জানিয়েছে, আইনটি পাশ হলেই প্রাথমিকভাবে কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে এই ধরনের গাড়ির অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হলো- এর ফলে ভারতের নিজস্ব গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এই নতুন ধরনের গাড়ি তৈরিতে নামতে পারবে। বিশেষ করে টাটা ইতোমধ্যেই সেই আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারতের যে ‘মটর ভিহাইকেল অ্যাক্ট ২০১৬’ পাশ হয়েছিল। সেখানে গাড়ি চালনায় নিয়ম ভঙ্গ হলে কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল। এটা নিয়ে তখন ভারতে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। কিন্তু সেই আইনটিকে সংশোধন করে এখন বলা হচ্ছে, যন্ত্রচালিত গাড়ির ক্ষেত্রে সরকার এই নিয়ম শিথিল করতে পারবে।

গাড়ি পরিচালনায় নতুন ধরনের উদ্ভাবনী আনার জন্যই এই ধরনের একটি মৌলিক আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। এই আইনটি এখন সংসদীয় কমিটিতে বিবেচনার জন্য রয়েছে। এটা পাশ করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে, এতে ভারতে নতুন উদ্ভাবনীর সৃষ্টি হবে। যাত্রীবাহী এবং মালবহনকারী উভয় ধরনের গাড়ির ক্ষেত্রেই এই আইনটি প্রযোজ্য হবে।

যদিও ভারতের বর্তমান রাস্তা চালকবিহীন গাড়ি চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়, কিন্তু এই ধরনের গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা সড়কগুলোকেও ঠিক করে ফেলবে। কর্তৃপক্ষ বলছে- প্রথমেই হয়তো এই ধরনের গাড়িগুলো কৃষিখাতে ব্যবহার করা হতে পারে কিংবা দূরপাল্লার রাস্তা; যেখানে সড়কে ঝামেলা কম। সেইসব রাস্তায় পরীক্ষা করা হতে পারে। বড় রাস্তায় গাড়ি নামাতে এখন আর কোনও আইনগত বাধা থাকবে না।

বর্তমান গুগল, টেসলা, চীনের বাইডু, মার্সিডিস, ফোর্ড, জেনারেল মটরস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা গাড়ি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। টেসলা মটরস’র সিইও ইলোন মাস্ক দাবি করেছেন যে, ২০১৭ সালের মধ্যেই টেসলা এমন গাড়ি তৈরি করবে যা আমেরিকার একপ্রান্ত লস এঞ্জেলস থেকে আরেকপ্রান্ত নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত চালকবিহীনভাবে চলে যেতে পারবে। সুইডেনের প্রতিষ্ঠান ভলভো তাদের সহযোগী হিসেবে নিয়েছে উবারকে। তারা যৌথভাবে যে গাড়ি তৈরি করছে, সেটা মূলত ‘রাইড শেয়ার’ করার জন্য – অর্থ্যাৎ, একটি গাড়ি অনেক যাত্রীকে নিয়ে একস্থান থেকে আরেকস্থানে যেতে পারবে; যে যার মতো উঠে এবং নেমে যেতে পারবে। গত সেপ্টেম্বরেই তারা এটা পরীক্ষামূলকভাবে রাস্তায় চালিয়েছে।

১৯২০-২১ সালের মধ্যেই এই গাড়িগুলো রাস্তায় দেখা যাবে।

উবারের বিরুদ্ধে গুগলের মামলা: গুগল দাবি করেছে যে, উবার তার প্রযুক্তি চুরি করে নিয়েছে। স্যান ফ্রান্সিসকো শহরে কোর্টে মামলা করে গুগল। ২৮ পৃষ্ঠার সেই অভিযোগপত্রে তারা বলছে, এন্থোনী নামের একজন গুগল কর্মী চাকরি ছেড়ে উবারে চলে যায়। পরে তিনি যে পিভোটাল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতেন, সেটাই উবারে আবার তৈরি করছে এবং সেটা মূলত গুগল থেকে চুরি করা ডিজাইন।

বিষয়টি আরও পুরনো। ২০১৫ সালে এই কর্মী গুগল ছেড়ে দিয়ে নিজেই একটি স্টার্ট-আপ দেন, যার কাজ ছিল দূরপাল্লার গাড়িগুলো চালকের সাহায্য ছাড়াই নেভিগেট করতে পারে। ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘অটো’। গত বছর ৬৮০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে উবার ‘অটো’-কে কিনে নেয়। এবং এন্থোনী বর্তমানে উবারের রোবট চালিত গাড়ির প্রজেক্ট দেখাশুনা করছে। ওই মামলায় বলা হয়েছে, বর্তমানে গাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে- তা খুবই ব্যয়বহুল এবং প্রতিশ্রুতিশীল। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু যে যাত্রীদেরকে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে শুধু এটাই নয় – এর মাধ্যমে পুরো গাড়ি শিল্পে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তাই এই ধরনের চুরি খুবই ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- উবার এবং গুগল অন্যদিক দিয়ে বন্ধুও বটে। গুগল উবারে ২৫৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে গুগলের নতুন পন্য ‘ওয়েজ’ তাদের ম্যাপ সেবা এমনভাবে বাড়াচ্ছে যা উবারের মতো কার-পুল সেবা দিতে যাচ্ছে। এর ফলে উবারের গ্রাহক টানতে পারে গুগল। ফলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। এবং এর রেশ ধরে উবারের বোর্ড থেকে গুগলের কর্মীকে সরে যেতে হয়েছে।

ওই মামলায় আরও বলা হয়েছে, এন্থোনী গুগল ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে গুগলের ১৪ হাজার গোপন ফাইল ল‌্যাপটপে করি করে নিয়ে গিয়েছিল। তার ভেতর ছিল সেন্সর বোর্ডের সার্কিট বোর্ড যার মাধ্যমে একটি গাড়ি বুঝতে পারে তার চারপাশে আর কী কী রয়েছে। পাশাপাশি আরও কিছু কর্মী গুগল ছেড়ে ‘অটো’-কে জয়েন করেছিল, যাদের কাছে গুগলের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ছিল। উবার সম্পর্কে আইন ভাঙ্গার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তারা সারা বিশ্বে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দেয়। এমনকি, গাড়িটি সঠিক মালিকানায় আছে কি না, কিংবা তার রোড পারমিট আছে কি না – সেগুলো না দেখেও ড্রাইভারকে উবারের সেবা নিতে দেয়।

গুগল আইনের আশ্রয় নিয়ে বলেছে, উবার যেন তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই ধরনের গাড়ি তৈরি করতে না পারে তার জন্য নির্দেশ দেয়।

বাংলাদেশ কী করছে: চালকহীন গাড়ি এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন বর্তমান বিশ্ব সোচ্চার, সেখানে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ কী করছে তথ্যপ্রযুক্তিতে! এটাই ভাবছিলাম। এই মুহূর্তে যে বিষয়গুলো মাথায় আসছে তার কিছু কিছু পয়েন্ট করছি-

– রোমান হরফে উচ্চারণের মতো করে বাংলা লিখব, নাকি সরাসরি কী-বোর্ড চেপে বাংলা লিখব, সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আমাদের।
– যেহেতু একুশের মাস, বাংলা নিয়ে আমাদের আরও মাতামাতি আছে। আমাদের অনেকেই ওসিআর বানিয়ে সরকারের কাছে মাত্র ৮ কোটি টাকায় বিক্রি করেছে, যার অস্তিত্ব কোথাও নেই। বাংলা একাডেমি এটাকে ব্যবহার করতে পারছে না। আর অন্যান্যদের কাছে এর কপিও নেই। কিন্তু একটি স্টার্ট-আপ এই ধরনের সফটওয়্যার বানিয়ে বিক্রি করে টাকাও নিয়ে গেছে।
– আমাদের আছে অ্যাপ তৈরির জন্য প্রকল্প, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ৫০০ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এখানেও সরকারের ৫ কোটি টাকার উপর খরচ হয়েছে। কিন্তু একটি অ্যাপও কেউ ব্যবহার করে না।

– বাসে বাসে বিনামূল্য‌ে ওয়াই-ফাই দিয়েছি। কিন্তু সেগুলো কিছুদিন যেতেই আর কাজ করে না।
– উদ্যোক্তা বানানোর জন্য আমরা উঠে-পড়ে লেগেছি; কিন্তু তাদের কোনও আইডিয়া সফল করতে সরকারি আমলাদের যে সিদ্ধান্ত লাগবে, সেই লাল-ফিতা পার হওয়ার মতো শক্তি কারও নেই।
– আমাদের চারপাশে অসংখ্য ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করে, এদিক-সেদিক করে কোনও একটি প্রকল্প পাশ করিয়ে নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
– ই-কমার্সে মোবাইল কোম্পানিগুলো আসতে পারবে কি, পারবে না – এটা আমাদের একটি বড় আলোচনা। মোবাইল কোম্পানিগুলো এলে, আমরা খাব কী!
– কারও ব্র্যান্ড, কিংবা মেধাসত্ত্ব কিংবা সফটওয়্যার অনায়াসেই আপনি চুরি করে ব্যবসা করতে পারেন। এটা নিয়ে কেউ কিচ্ছু বলবে না।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যে লাফালাফি করছে, সেগুলো এই দেশ গত শতাব্দিতেই করেছিল। এই শতাব্দির জন্য বাংলাদেশ কী করেছে, কেউ বলতে পারেন? পাশাপাশি আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাদের আমলাদের ব্রেইন তো পাল্টায়নি। সেই আগের শতাব্দিতেই রয়ে গেছে। তখন তারা মনে করতেন, সাবমেরিন ক্যাবল বসালে সব তথ্য চলে যাবে, এখন মনে করছেন- হোস্টিং বাইরে করলে দেশের সব তথ্য বাইরে চলে যাবে, কিংবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এই তো পার্থক্য! এই মাইন্ডসেট কে পাল্টবে এই দেশে!

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031