পুলিশের সোর্স রাজধানীতে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। কোথাও তারা নিজেরা সরাসরি করছে, আবার কোথাও লোক দিয়ে ব্যবসা করাচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তারা কখনো গ্রেফতার হয় না, যে কারণে ইয়াবা ব্যবসার প্রসার ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাড়া-মহল্লায় ইয়াবার কোনো নির্দিষ্ট স্পট নেই। মোবাইল ফোনেই এ ব্যবসা হচ্ছে। আগে ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের শুধু চিনত সেবনকারীরা। ধীরে ধীরে পুলিশের সোর্সরাও তাদের চিনতে শুরু করে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বখরা আদায় করতে করতে একপর্যায়ে নিজেরাই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরাও সোর্সদের কথামতোই ব্যবসা চালাচ্ছে। রাজধানীতে পুলিশের সোর্স পরিচয় দানকারী অন্তত দুই হাজার ব্যক্তি রয়েছে, যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় এই সোর্সদের নাম রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছেও এমন অভিযোগ অসংখ্য রয়েছে। সোর্সদের সম্পৃক্ততার কারণে ইয়াবা ব্যবসার প্রসার ঘটেছে খুব দ্রুত। আগে থানা পুলিশ পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা উদ্ধার করতে পারলেও বর্তমানে উদ্ধারের ঘটনা খুব একটা নেই বললেই চলে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন্স) তৌফিক আহমেদ বলেন, যারা মাদক ব্যবসায় রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই সোর্স বলে পরিচয় দিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করতে পারে। তবে সোর্সদের অনেকেই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে তাদের কাছেও খবর রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর ৪৯ থানার অধিকাংশ এলাকাতেই মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা চলছে। এসব এলাকায় যারা ব্যবসা করছে তাদের অধিকাংশই পুলিশের সোর্স হিসেবে চিহ্নিত। এরা মাঝেমধ্যে বিরোধী গ্রুপের দু-চারজনকে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যবসা নিরাপদ রাখে। রাজধানীর মতিঝিল, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীর চর, মিরপুর বিহারি পল্লী, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, খিলগাঁও, সবুজবাগসহ বিভিন্ন এলাকার সোর্সরা সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। মাঝেমধ্যে পুলিশের গাড়িতে চলাফেরার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মানুষ ভয়ে মুখ খোলে না। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত, বিভিন্ন অপরাধের তথ্য ও অপরাধীদের শনাক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় আসামি বা কোনোভাবে পুলিশের সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। এদের ‘সোর্স’ বলা হয়। নিয়মিত তথ্যদাতারাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘সোর্স’। তবে ‘সোর্স’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য নয়। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই তাদের বাছাই করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঝেমধ্যে একসময়ের অপরাধীদের সোর্স হিসেবে বাছাই করে সংশোধনের সুযোগ দেন। এ ছাড়া এলাকার নিম্নবিত্ত শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদেরও সোর্স হিসেবে বাছাই করা হয়। তারা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করে। এতে করে তারা বাড়তি আয়ও করতে পারে। কিন্তু এ সোর্সদের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে ক্ষমতা দেখিয়ে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে আটকের ভয় দেখাচ্ছে তারা। কেবল তা-ই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চলাফেরার কারণে তাদের অনৈতিক দাপটে সাধারণ মানুষজনকে থাকতে হচ্ছে আতঙ্কে। সূত্র জানায়, রাজধানীতে সোর্স দিয়ে পুলিশের অপরাধ করানোর অভিযোগ নতুন নয়। তবে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সোর্সদের কাছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, হাতকড়া ও পুলিশের ব্যবহূত বিভিন্ন সরঞ্জাম দেখা যায়। অনেকেই তাদের পুলিশও মনে করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে যারা ইয়াবা ব্যবসা করছে, তারা নিজেদের সোর্স হিসেবেই পরিচয় দেয়। পুলিশের গাড়িতে এদের দেখাও যায়। আসামি গ্রেফতারে এরাই থাকে বেশি তৎপর। গোয়েন্দাদের কাছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ী কথিত সোর্সদের তালিকাও রয়েছে। সূত্র জানায়, হাজারীবাগের সুইপার কলোনি গণকটুলী এলাকার তিন মাদক ব্যবসায়ী সপরিবারে অবাধে নেশাজাতীয় ইনজেকশন ও ইয়াবার ব্যবসা করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তাদের এক নিকটাত্মীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স। মাদকের মূল ডিলারও ওই সোর্স। সোর্স পরিচয়ের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তারা। লালবাগ থানার অসীমের সহযোগীরা হাজারীবাগ এলাকার সুইপার কলোনিতে মাদক ব্যবসা চালায়। লালবাগ এলাকায় চিহ্নিত এক সন্ত্রাসীর স্ত্রীর রয়েছে বিশাল মাদক ব্যবসা। ওই মহিলাও স্থানীয় থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। ধানমন্ডি, কাঁটাবন, গ্রিন রোড ও ফার্মগেট এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে কয়েকজন নারী ও পুরুষ। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এরা র্যাব পুলিশের এক সোর্সের স্বজন। লালবাগ থানার একসময়ের প্রভাবশালী দুই সোর্স এখন মতিঝিল, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফেনসিডিল ও ইয়াবা সরবরাহকারী হিসেবে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য অধিদফতরে রেকর্ডভুক্ত। খিলগাঁও থানা পুলিশের সোর্স ওহাব গোড়ান এলাকার ছাপড়া মসজিদের পাশে আদর্শবাগের গলিতে ইয়াবা ও ফেনসিডিল ব্যবসা চালায়। সবুজবাগের ওহাব কলোনিতে পাওয়া যায় না এমন কোনো মাদক নেই। একটি বিশাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে ওহাব কলোনির মাদক ব্যবসা। লালবাগ থানার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী সাহা বর্তমানে মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানার সোর্স বলে নিজেকে পরিচয় দেয়। মিরপুরে মাদক বেচাকেনা হয় শাহআলী থানা এলাকায়। মাদক ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই পুলিশ সোর্স। শাহআলী ও দারুস সালাম থানা পুলিশের এক সোর্সের স্ত্রীও বড়মাপের মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসার টাকায় নাজু নামের ওই মাদকসম্রাজ্ঞী মিরপুরের ডিয়াবাড়ী বটতলা এলাকায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছে। দারুস সালাম থানায় তার একটি মাইক্রোবাস চলছে ভাড়ায়। এ ছাড়া পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি এলাকায় জসিম, চোরা লিটন, জামান মল্লিক, সারোয়ার, তপন, বিমান, জয়া, সেন্টু, দেলু, জামান, লিটন, শম্ভু, মনোয়ারা, সেলিম, কানাই, শামসুদ্দিন সামসু, জাহাঙ্গীর, রিপন, শাকিল, সুজন, মাসুদ, সাব্বির, বাবলু, মিল্টন, বাপ্পী, কানাই ঘোষ, শফিক, মুজিবর; নবাবপুর ও ঠাঁটারীবাজারে ইয়াবা ঝিলু, তার মেয়ে সিসিলি, ফেনসি রমজান, কানা জাহাঙ্গীর, জসিম, চান্দু, শাকিল, সুজন, পুরি মাসুদ, সাব্বির, রনি, বাবলু, সায়দার, শংকর, কুমিল্লা রফিক, চাঁদপুইরা সফিক; লালবাগ, হাজারীবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গীর চর এলাকায় বিরানী মামুন, ফারুক, আক্তার, টুন্ডা, ইব্রাহিম, জাফর, লিটন, বখতিয়ার, জসিম, রনি, শাহজাহান, ওয়াসিম, রিপন, বিল্লাল, আবদুর রব, আলমগীর, সিডি মিন্টু, সোহেল, আরিফ, আশরাফ, বাসেত, আজমল, তৌহিদ; দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় লালবাবু, বাবু সেলিম, জাকির মাঝি ওরফে কাইল্লা জাকির, ইয়াবা রনি, শিবলী ওরফে শিবলিস, সোহাগ, আমিরুল, সোহেল, শিপন, জাহাঙ্গীর, ভাগিনা রবিন, নজরুল, লালু, রহিম, আলী, বুড়ি, শাহে আলম, রহিমা, আলতাফ, ভাইয়া সেলিম, মাসুম, সুমন, শাহীন, সালাম, ফর্মা সিরাজসহ অনেকে করছে ইয়াবার ব্যবসা