হাইকোর্ট উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাসংক্রান্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদের ৯৫(২)(খ), ৯৮, ১১৫, ১১৬ এবং ১১৬(ক) এর সংশোধনী কেন অবৈধ ও সংবিধানের ২২ ও ১০৯ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন । এছাড়া অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এ প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ব্যতিত সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করার যে বিধান রয়েছে তাতে বিচারক নিয়োগেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ না রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তি কেন করা হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রবিবার এ রুল জারি করেন। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে আইন সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্পিকার ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রিট আবেদনের শুনানিতে অংশ নেন রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ রিট আবেদনটি করেছেন। তবে রিটে কী রুল হয়েছে সেই বিষয়টি আদেশের কপি ছাড়া বলা যাবে না।
রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদের ৯৫(২)(খ), ৯৮, ১১৫, ১১৬ এবং ১১৬(ক) এর সংশোধনী কেন অবৈধ ও সংবিধানের ২২ ও ১১৯ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বিষয়ে ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।
আদালতসমূহের উপর সুপ্রীম কোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল (আদালত ও ট্রাইব্যুনালের) উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকিবে।
ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ অধঃস্তন আদালতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্টের। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৪র্থ সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ওই ক্ষমতা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। যা সংবিধানের সাংঘর্ষিক। কারণ সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রপতি স্বাধীন নন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতি নিয়োগে অন্য শর্তের সঙ্গে জেলা জজদের জন্য কমপক্ষে তিন বছরের জেলা জজ হিসেবে অভিজ্ঞতার বিধান থাকলেও সেই বিধান ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানে বাতিল হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সেই ১৯৭৮ সালের সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করলেও ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীতে ১৯৭৮ সালের সংশোধনী বহাল রাখে। যা সুপ্রিম কোর্টের মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনুচ্ছেদ ১০৯ এর সঙ্গে অনুচ্ছেদ ১১৬ সাংঘর্ষিক। কারণ ১০৯-তে উল্লেখ আছে, হাইকোর্ট বিভাগের কাছে অধস্তন সকল আদালতের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয়া আছে। ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানে ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে শব্দগুলি যোগ হলেও সেই ফরমান সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৯৫(গ) অনুচ্ছেদে আইন তৈরি সাপেক্ষে বিচারপতি নিয়োগের বিধান থাকলেও সংসদে কোনো আইন ছাড়াই দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে যা সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের সাংঘর্ষিক।
রিটকারী আইনজীবী জানান, সংবিধানের ৯৫(২)(খ) যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতি নিয়োগে জেলা জজ হিসেবে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ছিল। যা ১৫তম সংশোধনীতে বাতিল করা হয়। ২০১১ সালে আনা ১৫তম সংশোধনীতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত ৯৫(২)(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বছর কোন বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে।
ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ৯৮ অনুচ্ছেদে যেখানে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে নিয়োগের বিধান ছিল, কিন্তু ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই আলোচনার বিধান বাতিল করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা দেয়া হয়। ১১৫ অনুচ্ছেদে যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল সুপ্রিমকোর্টের সুপারিশ ছাড়া নিম্ন আদালতের জেলা জজ নিয়োগ দেয়া যাবে না। অন্যান্য পদে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়োগ দিতে হবে এবং কমপক্ষে সাত বছর জুডিশিয়াল অফিসার না থাকলে তাকে জেলা জজ হিসাবে নেয়া যাবে না। কিন্তু ওই সকল বিধান করে ১৯৭৪ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে নেয়া হয়। ১১৬ অনুচ্ছেদে ১৭৭২ সালের সংবিধানের নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ বদলি, পদন্নতি সমস্ত সুপ্রিমকোর্টের হাতে ন্যস্ত ছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনী মাধ্যমে তা রাষ্ট্রপতির হাতে নেয়া হয়। ১১৬(ক) ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল না। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে নিম্ন আদালতকে স্বাধীনতা দেয়া হয়।
১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী আনা সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত বিচারকগণ নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ৯৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতির নিকট সুপ্রীম কোর্টের কোন বিভাগের বিচারক-সংখ্যা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করা উচিত বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বৎসরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করিতে পারিবেন, কিংবা তিনি উপযুক্ত বিবেচনা করিলে হাইকোর্ট বিভাগের কোন বিচারককে যে কোন অস্থায়ী মেয়াদের জন্য আপীল বিভাগের আসন গ্রহণের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, অতিরিক্ত বিচারকরূপে নিযুক্ত (কোন ব্যক্তিকে এই সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের অধীন বিচারকরূপে নিযুক্ত) হইতে কিংবা বর্তমান অনুচ্ছেদের অধীন আরও এক মেয়াদের জন্য অতিরিক্ত বিচারকরূপে নিযুক্ত হইতে বর্তমান অনুচ্ছেদের কোন কিছুই নিবৃত্ত করিবে না।
অধস্তন আদালতে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ১১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।
অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।
বিচারবিভাগীয় কর্মচারীগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন সংক্রান্ত বিষয়ে ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়, এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।
ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতিত অন্য সব ধরনের দায়িত্ব পালনের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কার্য করিবেন। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের, দলীয় বিবেচনায় বহু কিছু হচ্ছে। এই জন্য ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে জজ নিয়োগেও পরামর্শ হবে না এই মর্মে বিষয়টি সংশোধন চেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) বলা হয়েছে, এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
গত ৩ নভেম্বর এই রিটটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটের শুনানি নিয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি শেষে রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। রিট আবেদনে জাতীয় সংসদের স্পিকার, আইনসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বিবাদী করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল চেয়ে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, সংবিধানের ১১৬ অনচ্ছেদ বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ। তার এই বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যপক আলোচনার জন্ম দেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদের ফলে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
রিটকরার বিষয়ে ইউনুছ আলী আকন্দ ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিচারক নিয়োগ, পদন্নোতি ও বদলিসংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ আইন ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি। তাই এই দুই ধারা বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধানের ফিরে যেতে রিটটি করা হয়েছিল। তিনি জানান, বাহাত্তরের মূল সংবিধানে অধঃস্তন আদালতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব ছিলে সুপ্রিম কোর্টের। কিন্তু ১৯৭৫ এর চতুর্থ সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ওই ক্ষমতা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া সংবিধানের ৯৫(গ) অনুচ্ছেদে আইন তৈরি সাপেক্ষে বিচারপতি নিয়োগের বিধান থাকলেও সংসদে কোনো আইন ছাড়াই দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবত বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে এটাও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রিট আবেদনে সংবিধানের এই ধারা বাতিল চাওয়া হয়েছে।