বিভিন্ন বাজারে বিক্রী হওয়া হলুদ, মরিচ ও মিক্সড মসলায় মানবদেহের ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে । বিশেষ করে ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল ও ইট, কাঠ, ভুট্টা, চালের গুঁড়ার মিশ্রণ রয়েছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কৃষি কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুড়া মসলায় সাইপারমেথরিনের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএমের স্থলে ০.৭৩ পিপিএম, ডায়াজিননের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম স্থলে ০.১৯ পিপিএম পাওয়া গেছে। যা মানুষের শরীরের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর। তবে ভেজালকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘ও কিছু না, বাংলার পেটে সব সয়’
অথচ প্রতিবেদনে বলা হয়, মসলায় মেশানো রাসায়নিক দ্রব্যের জীবাণু গ্রহণ করায় মানুষের শরীরে ক্যান্সার, কিডনি, লিভার আক্রান্তসহ অন্তত ৫০ ধরনের মারাতœক রোগ ছড়াচ্ছে। যার ভয়াবহতায় অকালে ঝরছে অসংখ্য প্রাণ।
সচেতন মহলের অভিযোগ, অতি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা মসলায় ভেজাল দিচ্ছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের এসব তদারকির কথা তারা রহস্যজনক কারণে নীরবতা পালন করছে। উৎকোচ থাকায় অভিযান থেকে বিরত রয়েছে বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) কর্মকর্তারা।
যদিও বিএসটিআইয়ের মান নিশ্চিতকরণ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জহিরুল আলম উৎকোচের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা কিংবা বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সব মসলা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
নগরীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এক গবেষক বলেন, মসলায় মেশানো ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়া, ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কীটনাশক দ্রব্য ফুটিয়ে রান্না করলেও এর বিষক্রিয়া নষ্ট হয় না। যা দীর্ঘ সময় গ্রহণে শরীরে মারাতœক সব রোগ সৃষ্টি হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে শূন্যের দিকে নামতে থাকে। যার ভয়াবহতায় গর্ভবতী নারীদের থেকে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মের আশঙ্কা থাকে।
প্রতিবেদনে মসলা পরীক্ষার শুরুর প্রক্রিয়া অংশে বলা হয়, গবেষণার প্রয়োজনে গবেষক দল স¤প্রতি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, রিয়াজ উদ্দিন বাজার, বহদ্দারহাট, রাজধানীর সাভার, গাজীপুর ও পুরান ঢাকায় অবস্থিত কয়েকটি মসলা কো¤পানির গোডাউন পর্যবেক্ষণ ও মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় তারা মরিচ ও হলুদের সঙ্গে মেশানোর জন্য মরিচ ও হলুদের সাদা, কালো, পচা, বোঁটা ও বীজসহ খাবার অনুপযোগী নানা উপাদান মজুদের (সংরক্ষণ) চিত্র দেখতে পান; যা রাখা হয়েছে শুধু চটের বস্তায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার গোডাউনে।
তারা দেখেন, এসবের অধিকাংশ বস্তা ইঁদুরে কেটেছে। দীর্ঘদিন খোলা থাকা বস্তায় মরিচের গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতার প্রভাবে এসব কাঁচামালে অতিরিক্ত ময়েশ্চারসহ জন্ম নিচ্ছে মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টির উপাদন আফলাটক্সিন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুঁড়া মরিচের আদর্শমান ১০১৭ বিডিএস, হলুদের ৯৯১ বিডিএস এবং মিক্সড মসলায় ১২০৫ বিডিএস হলেও বাজারজাত হওয়া মসলার অধিকাংশেরই আদর্শমান অর্ধেকেরও কম। নিম্মমানের উপকরণ ও অতিরিক্ত রাসায়নিকের কারণে মসলায় আদর্শমান রক্ষা হয়নি।
মসলার নিম্মমান হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে অর্ধশত কো¤পানি ১০০টিরও বেশি জাতের বিভিন্ন মসলা বাহারি নামে বাজারজাত করছে। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশই কাঁচামাল উৎপাদন করছেন না। তারা টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ম দরদাতার কাছ থেকে নিম্মমানের কাঁচামাল সংগ্রহ করছে। যেসব কাঁচামালে মাঠের ফসল মাড়ানো থেকে শুরু করে পরিষ্কার, শুকানো, মিশ্রণ, সংরক্ষণসহ কোনো প্রক্রিয়ায়ই স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। মরিচ ও হলুদ রাস্তার ধারে, টিনের চালে, গোলার অপরিষ্কার পরিবেশে শুকানো হচ্ছে।
পাশাপাশি ওজন ও পরিমাণ বাড়াতে গুঁড়া মরিচে সাদা, কালো, পচা মরিচসহ বীজ ও বোঁটা মেশানো হচ্ছে। এতে মরিচের লাল রঙ কমে যাচ্ছে। আর গুঁড়া মরিচের রঙ গাঢ় লাল করতে উৎপাদক কো¤পানিগুলো উজ্জ্বল লাল বর্ণের স্বাদ ও গন্ধহীন রাসায়নিক পেপরিকা মেশাচ্ছে। ক্ষেত থেকে হলুদ উঠানোর পর সঠিক নিয়মে ঘাম ঝরানো, সিদ্ধ ও শুকানো হচ্ছে না। ফলে রঙ হারাচ্ছে হলুদ। কিন্তু রঙ ফেরাতে ও ওজন বাড়াতে সিদ্ধ করার সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্রোমাটেড মেশানো হচ্ছে। এছাড়া শুকানোর পর মিশ্রণ করা হচ্ছে মেটালিল ইয়োলো, ফিটকিরি, টেক্সটাইল ডাই পিউরিসহ বিভিন্ন রাসায়নিক।
আবার মিক্সড মসলায় ব্যবহার হচ্ছে খুবই নিম্মমানের উপকরণ। এমনকি মূল্যবান দারুচিনির পরিবর্তে নিম্মমানের ক্যাসিয়াসহ বিভিন্ন উপকরণ মেশানোর প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া ক্ষতিকারক অন্যান্য রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে মিক্সড মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণে।
এদিকে মসলা গবেষক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, মরিচের বীজ ও বোঁটা খাবার অনুপযোগী হলেও ক্যাপসাইসিল খ্যাত এসব বীজ-বোঁটা মিশ্রণ করে গুঁড়া মরিচে মেশানো হচ্ছে, যা কখনোই পানিতে ও শরীরে মেশে না। এছাড়া সঠিক পদ্ধতিতে মরিচ ধোয়া ও না শুকানোর কারণে গাছে ব্যবহার করা অত্যধিক রিংডেন, ইউনালফস, এসিফেড, টায়োফজ, সাইপারমেথরিন, ডাইকোফল, ডায়াজিনন, স্যামকোজলসহ বিভিন্ন কীটনাশক শুকনো মরিচে থেকে যাচ্ছে। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব রান্নার পরও থেকে যায়।
চমেক হাসপাতালের কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ভেজাল ও কীটনাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করায় সব বয়সের মানুষ মারাতœক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে; যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তিনি জানান, ১০ বছর আগেও এ দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ। গত বছর তা দুই কোটি ছাড়িয়েছে। এছাড়া দেশে বছরে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী আবুল কাসেম মুন্সি বলেন, দেশের সবকিছুতেই ভেজাল। ভেজাল মসলা খেয়ে মানুষ মরেছে তার কোন প্রমাণ নেই। মসলায় ভেজাল ‘ওটা কিছুই না, বাংলার পেটে সব সয়’।