বাংলা ও ইংরেজির মিশেলে ‘বাংরেজি’থেকে ছেলেমেয়েদের সরিয়ে আনতে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। নিজের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষায় কথা বলা স্বকীয়তার পরিচায়ক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিন্তু প্রচলিত বাংলা ভাষাকে কোনোভাবেই বিকৃত করা যাবে না।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৭ উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি এবং বলি। কিন্তু ইদানীং ইংরেজির সাথে বংলা মিশিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারা এমন ভাব দেখায়, যেন এভাবে কথা না বললে তাদের মর্যাদাই থাকে না। এই জায়গা থেকে তাদের সরিয়ে আনতে হবে।’
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন যেটা বলবে সেটা ঠিকমতো সঠিকভাবে বলবে, সঠিকভাবে উচ্চারণ করবে এবং ব্যবহার করবে।’
আমাদের ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা সাতই মার্চের ভাষণে গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি এ ভাষা সব সময় ব্যবহার করতেন।’
বঙ্গবন্ধুর আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে তার শিক্ষকদের কৌতূহল প্রকাশের স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু-তনয়া বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়তাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক মাঝে মাঝে বলতেন, “উনি (বঙ্গবন্ধু) এভাবে বলছেন কেন?” তখন আমি বলতাম, “স্যার উনি (বঙ্গবন্ধু) যখন কথা বলেন জনগণের জন্যই বলেন। জনগণ সহজে উপলব্ধি করবে এবং জনগণের হৃদয়ে পতিত হবে সেটাই বলতেন। এটাকে সংশোধন করা যায় না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষা বলব। কিন্তু আমাদের প্রচলিত ভাষাকে যেন বিকৃত করে বাংরেজি না হয়। সেই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত।’
মাতৃভাষায় কথা বলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ভাষাকে গুরুত্ব সব সময়ই দিব, কিন্তু এর জন্য অন্য কোনো ভাষার সাথে বৈরিতা নয়। জ্ঞান অর্জনের জন্য আমরা অন্য যেকোনো ভাষা শিখতে পারি।’ বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখার জন্য তার সরকার একটি অ্যাপস তৈরি করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে নয়টি ভাষা শেখা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে আমাদের বাংলা ভাষা অর্জন। ভাষাশহীদরা এই ভাষা আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। এর যেন অমর্যাদা না হয়।’
ভাষাভাষীর দিক দিয়ে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ ভাষা বাংলা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের একটি প্রচেষ্টা আছে বাংলা ভাষাকে যেন জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু এটা কার্যকর করতে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। তারপরও আমরা আমাদের দাবিটা তুলে রেখেছি। হয়তো এটা একদিন কার্যকর হবে।’
তিনি বলেন, ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা এই ভাষার অধিকার অর্জন করেছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি তেমন করে তুলে ধরা হচ্ছে না। এটি বিশ্বের দরবারে আরো বেশি করে তুলে ধরতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বর্ণনা তুলে ধরেন তার বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পরই আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ আমাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে পৃথিবীর যত মাতৃভাষা আছে সেগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা করা। ২০০১ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান বাংলাদেশে এসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।’
কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা পরের সরকার এই ইনস্টিটিউট তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরপর ২০০৮ সালে আমরা ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় কাজ শুরু করি এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন পাস করা হয় এবং এর উদ্বোধন করা হয়।’ যারা ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন, তাদের মনের খোরাক জোগান দিতে পারবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট-সেই অনুযায়ীই এটা গঠনে তারা কাজ করছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছে যাদের লেখন পদ্ধতি নেই। কিন্তু তারা মুখে নিজের ভাষায় কথা বলে। মাত্র চার-পাঁচটা নৃ-গোষ্ঠী আছে যাদের লেখন পদ্ধতি আছে। এবারই আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার প্রায় ২৪ হাজার বই ছাপিয়ে তাদের মাঝে বিতরণ করেছি। যাতে তারা তাদের মাতৃভাষা শিখতে পারে।’
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ভারতের শিক্ষাবিদ নমিতা সেন প্রমুখ।