৪৯ বর্গফুটের এই ঘরেই গাদাগাদি করে আট সদস্যের পরিবারের বসবাস।সাত ফুট লম্বা আর সাত ফুট চওড়া একটি ঘর। ট্রেন লাইন থেকে মাত্র দেড় ফুট দূরত্বে মোটা প্লাস্টিকের কাগজ, ত্রিপল বা বেড়ার ঘরগুলোতে নেই গ্যাস, পানি বা বিদ্যুতের সংযোগ।
কারওয়ানবাজারে রেললাইন ঘেঁষা এমন একটি ঘরে ভাড়া কিন্তু রাজধানীর অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি।
কথা হয় কাওরানবাজার সেই ৪৯ বর্গফুটের ঘরের কর্তী সুমনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মরণের ডর লইয়া এহানে গত তিন বসসর ধইরা থাকতাসি। আগে ভাড়া দেওন লাগত ৮০০ টেহা আর এহন দেওন লাগে তিন হাজার টেহা।’
৪৯ বর্গফুটের ভাড়া তিন হাজার টাকা হলে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া পড়ে ৬১ টাকা। রাজধানীর যে অভিজাত এলাকায়ও এর চেয়ে অনেক কম হারে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
অনলাইনে গুলশানের বাড়িভাড়ার একটি বিজ্ঞাপনে আড়াই গুলশান এলাকার একটি বাড়ির ভাড়া চাওয়া হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। ওই বাড়িটি আড়াই হাজার বর্গফুটের। সপ্তম তলায় তিন শয়নকক্ষের ওই ফ্ল্যাটে তিনটি অ্যাটাচ বাথরুম, একটি কমন বাথরুম, একটি বসার কক্ষ, গৃহপরিচারিকার জন্য আলাদা কক্ষ, ওয়াল কেবিনেট, দুটি বারান্দা, গাড়ি পার্কিং সুবিধা, লিফট, বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর এবং সার্বক্ষণিক দাঁড়োয়ান সুবিধা রয়েছে। এতসব সুবিধার পরও ওই বাড়িতে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া পড়ে ২২ টাকা।
অর্থাৎ এই ফ্ল্যাটে বর্গফুট প্রতি ভাড়া কারওয়ানবাজারের সেই বস্তির তুলনায় প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
গুলশানেই এক হাজার ৮০০ বর্গফুটের আরেকটি বাড়ি ভাড়া চাওয়া হয়েছে ৬০ হাজার টাকা, অর্থাৎ এখানে বর্গফুটপ্রতি ভাড়া পড়ে ৩৩ টাকা।
আরেক অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির ছয় নম্বর সড়কে এক হাজার ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া চাওয়া হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বর্গফুটপ্রতি সেখানে ভাড়া পড়ে ২২ টাকা। সেখানেই নিরাপত্তা, লিফটসহ সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
অভিজাত এলাকা বাদ দিলে মধ্যবিত্তের আবাস রয়েছে এমন এলাকা যেমন উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, রামপুরাসহ অন্য এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বর্গফুট হারেই ভাড়া পাওয়া যায় মানসম্মত বাসা।
এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলাই যায়, বস্তিবাসী অতিরিক্ত টাকা দিয়ে নি¤œমানের বাড়িতে অধিকারহীনতার মধ্য দিয়ে থাকে।
সরকারি হিসেবে ঢাকায় বস্তির সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি। ঢাকার মোট জনস্যংার ৩৫ শতাংশই থাকে এই বস্তিতে। তাদের আবাস আর জীবনমান উন্নয়নে এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোন পক্ষ থেকে উল্ল্যেখযোগ্য কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। দখল উচ্ছেদের নামে বস্তি ভেঙে দেয়ার ঘটনাই ঘটছে বারবার। এ নিয়ে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কোনো বাক্য শোনা যায়নি।
বেসরকারি সংস্থা আইসিডিডিআরবির মতে, ‘১৯৯১ সালে ঢাকার বস্তিঘর ছিল দুই হাজার ১৫৬টি, পাঁচ বছর পর তা বেড়ে দাড়ায় তিন হাজারে।’ তবে বর্তমান নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বর্তমানে তা দশহাজার ছেড়েছে ছেড়েছে বলে মনে কওে সংস্থাটি। যেখানে বসবাস করা সমাজের নি¤œ শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে প্রতিদিন জীবন যুদ্ধে অংশ করে বাঁচতে হয়।
যেভাবে থাকে বস্তিবাসী
বৃহস্পতিবার বেলা তিনটা। কারওয়ান বাজার রেল লাইন বস্তির চিত্র। একটি গোসলখানায় নারী এবং পুরুষ একঙ্গে গোসল করছেন। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরও বহু মানুষ।
এই বস্তির বাসিন্দা পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি মাত্র গোসলখানা রয়েছে। সেখানে থাকা একটি পানির লাইন থেকেই খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়।
কাওরানবাজারের স্থানীয় বস্তির বাসিন্দা কালাম হোসাইন বলেন, ‘কী আর করুম কন, পানির লাইন একটা। সরকার তো আমাদের থাহন, খাওনের লইগ্যা কিছুই করে না।’ বস্তিবাসী হিসেবে নিজেদের দুর্ভাগা বলে মনে করেন কালাম।
এই বস্তিতে পয়ঃকাজের জন্য আছে পাঁচটি মাত্র আধাপাকা টয়লেট। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একটি করে। টয়লেটগুলো অবস্থাও খুব একটা সুবিধাজনক নয়। টয়লেটের সামনে সকালে দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা যায়। লাইনের অপেক্ষায় না থেকে আশেপাশের রাস্তার ফুট পাতেই টয়লেটের কাজ সারতে বাধ্য হয় অনেকে।
এই তুলনায় মহাখালীর করাইল ও সাততলা বস্তির অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে সেখানেও অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয় মানুষ। সাততলা বস্তির ইসমাঈল হোসেন বলেন, ‘আয় কম দেইখা বস্তিতে ভাড়া থাহি। কিন্তু বাড়িওয়ালারা দিন দিন যেমনে ভাড়া বাড়াইতাসে, ভবিষ্যতে পুলাপাইন নিয়া রাস্তায় নামতে হইব।’
সরকারি সংস্থাগুলো কী ভাবছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারের ২০০৯ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী বস্তিবাসিদের ভবন করে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সেই পরিকল্পনাটি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিশেষ করে কড়াইল ও সাততলা বস্তিগুলোতে ভাড়া অন্য যে কোনো বস্তির চেয়ে বেশি। কিন্তু এই ভাড়ার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই।
তাহলে এভাবেই কি চলবে?- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গরিবদেও আবাসন সংকট নিরসনে সরকার ও সিটি করপোরেশনের কিছু পরিকল্পনা আছে। দাতারাও এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। তবে ঢাকায় জমির সংকটই প্রধান সমস্যা।
কাজে আসেনি ভাসানটেক প্রকল্প
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বস্তিবাসীদের আবাসন সংকট সমাধানে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সে সময় প্রশংসিত প্রকল্পটি পরে দুর্নীতি আর চরম অববস্থাপনায় পড়ে। আর এরপর বস্তিবাসীদের আবাসন সংকট নিয়ে সরকার আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সে সময় সরকার মিরপুরের ভাসানটেক এলাকায় বস্তিবাসী ও নি¤œ আয়ের মানুষদেও জন্য টাইপ ‘এ’ ও টাইপ ‘বি’- দুটি শ্রেণিতে আটটি ভবন নির্মাণ করে। এগুলো ৯৩৮টি পরিবার বসবাস করছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সাউথ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে (এনএসপিডিএল) সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বস্তিবাসীদের বদলে সম্পদশালীদের কছে এসব ফø্যাট বিক্রি করে বলে অভিযোগ উঠে।