বিশ্বাস করুন- ও মরলে আমি শান্তি পাবো। মুক্তি পাবো। ‘প্লিজ ম্যাডাম, আমার সন্তানকে যেভাবেই হোক মেরে ফেলুন। কাউকে কিছু বলবো না। কোনো মামলাও করবো না। ’ মাদকাসক্ত এক পুত্রের নির্যাতনে অতিষ্ঠ এক মায়ের আকুতি এটি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা রহমান দিনার কাছে এমন আকুতিই জানাচ্ছিলেন এক অসহায় মা। শুধু তাই নয়, ডা. ফারজানার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা আরেক মা তার করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন। কিভাবে তার কন্যা সন্তানকে মাদকাসক্ত পুত্র পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন সে কাহিনী জানান চোখের জলে। আর মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে এক বিত্তশালী পরিবারের কন্যার কথা জানাচ্ছিলেন ডা. ফারজানা। বলেন, ওই মেয়ে আমাকে বলে, ম্যাডাম মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আমি এলাকার যত রিকশাওয়ালা ও বাসচালক আছে সবার সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। ডা. ফারজানা রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক। শনিবার ‘মাদকের ভয়াল আগ্রাসন’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে তিনি মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরতে গিয়ে এসব কাহিনী উপস্থাপন করেন। সত্যিই মাদকের ভয়াল আগ্রাসন এখন ঘরে ঘরে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মাদকাসক্ত পরিবারের চরম অশান্তির কথা। মাদকের টাকা দিতে পিতা-মাতাকে অত্যাচার। বোনকে অপহরণ করে টাকা আদায়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। মাদকাসক্ত সন্তানের কাছে যেন গোটা পরিবারই জিম্মি। প্রায়ই শোনা যায় মাদকাসক্ত পুত্রকে পুলিশে দিয়েছেন পিতা। কিংবা মাদকাসক্ত পুত্রের হাতে মায়ের মৃত্যুর খবর। রাজধানীর নাখালপাড়া মসজিদ গলির এক বাসার ভাড়াটিয়া মাদকাসক্ত পুত্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। প্রতিদিনই তাকে মাদকের টাকা দিতে হবে। না দিলেই মারধর ও ভাঙচুর চালায় ঘরে। একদিন টাকা না পেয়ে ঘরের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। ওই জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পান শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে। গত বছর জুন মাসের কথা- টাকা না পেয়ে নিজের ছোট বোনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় মাদকাসক্ত নাজিম। এরপর পিতা-মাতার কাছে ফোনে জানায় টাকা দিলেই মেয়েকে ফেরত দেয়া হবে। ১৭ ঘণ্টা পর মাত্র এক হাজার টাকা পণ দিয়ে পুত্রের কাছ থেকে মেয়েকে মুক্ত করেন পিতা। গতকাল এ বর্ণনা দিতে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন তার পিতা আজমল মিয়া। বলেন, আমি নিশ্চয় কোনো পাপ করেছি। যার সাজা পাচ্ছি। যে বয়সে আমার বসে বসে খাওয়ার কথা। যে বয়সে সন্তান রুজি করে আমাকে খাওয়ানোর কথা, সেই বয়সে দিনমজুরি করে আমার ৩০ বছর বয়সের সন্তানকে টাকা দিতে হচ্ছে মাদকের জন্য। তিনি জানান, একদিন ঘরে এসে দেখি সন্তান তার মাকে দা দিয়ে কুপিয়েছে। রক্ত ঝরছে। ছেলে মা’র কান থেকে স্বর্ণ লুটে পালিয়েছে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখন আমি আর বাঁচতে চাই না। মুগদা এলাকার আরশাদ আলী নামে এক পিতা বলেন, মাদক আমার পুরো পরিবারকে খেয়েছে। আমার বড় আদরের পুত্র রশীদ কিভাবে যে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে বুঝতেই পারিনি। কলেজে যাওয়ার জন্য টাকা দিতাম। সে টাকা দিয়ে সে মাদক কিনে খেতো। এক সময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এখন আর টাকা দেই না। এতেই ঘটে বিপত্তি। একে একে ঘরের এটা-ওঠা চুরি হতে থাকে। বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। একদিন বুঝতে পারি ছেলে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমার কিছুই করার ছিলো না। আমার বাসায় গিয়ে দেখুন শোকেস ভাঙা। খাট জোড়াতালি দেয়া। টাকা না পেলেই সে এসব ভাঙচুর করে। এখন আর ঘরে থাকে না। সপ্তাহ, দশ দিন পর কোথা থেকে এসে হাজির হয়। সেও টাকার জন্য। সম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে বিদায় করে দেই। এভাবে আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না। ছোট মেয়েটার বিয়ে দিলে মুক্ত হয়ে যেতাম। তখন মরে গেলেও কোনো ক্ষতি হতো না। আরশাদ বলেন, মাদকের মধ্যে এখন সহজলভ্য হলো ইয়াবা। ইয়াবা খেলে শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন ওর সঙ্গে শক্তিতেও আমরা পারি না।
মাদকাসক্ত সন্তানের নানা কাণ্ড নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই এসব ঘটনা খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ২০১০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় মাদকের টাকা না পেয়ে এক যুবক ঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আগুনে পুড়ে মারা যায় তার ভাইয়ের শিশুকন্যা। অগ্নিদগ্ধ হন তার ভাই ও ভাবি। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামের এ ঘটনা তখন দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এ ঘটনার পর মাদকাসক্ত আলমগীর বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
পাথরঘাটা গ্রামের আকবর আলীর তিন পুত্রের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন ব্যবসা করেন। মেজো ছেলে আলমগীর হোসেন মাদকাসক্ত। বাড়িতে আলমগীর নানাভাবে উৎপাত করতেন। নেশা করার টাকা না দিলে আলমগীর বাবা-মাকে কয়েক দফায় মারধর করেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে নেশার পথ থেকে ফেরানো যায়নি। সে সময় পরিবার থেকে জানানো হয়েছিল ব্যবসা করার জন্য কয়েক দফায় তাকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দেয়া হয়। কিন্তু সে ফেনসিডিলের ব্যবসা করতে গিয়ে ও মাদক সেবন করে সব টাকা নষ্ট করে ফেলে। আলমগীর আরো দুই লাখ টাকা দাবি করে না পেয়ে ঘরে আগুন দেয়। গতবছর ৯ই অক্টোবর চট্টগ্রামে ঘটে আরেক ঘটনা। মাদকের টাকা না পেয়ে স্বামী রুবেল তার স্ত্রী মরিয়মকে পাথর ছুড়ে হত্যা করে। এ ঘটনাও সে সময় আলোচনায় আসে দেশজুড়ে। চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার কাটাপাহাড় এলাকায় ঘটে এ ঘটনা। রুবেল ছিল ভাসমান। নগরীর ডিসি হিল, কাজীর দেউড়ি ও কাটাপাহাড় এলাকার ফুটপাথে রাত কাটাতো।
মরিয়ম কাগজ কুড়িয়ে টাকা উপার্জন করতো। যার একটা অংশ রুবেল নিয়ে যেত মাদকের জন্য। ওই দিন দুপুরে মাদক সেবনের জন্য মরিয়মের কাছে টাকা চায় রুবেল। মরিয়ম টাকা দিতে রাজি না হলে দুজনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে পাথর ছুড়লে ঘটনাস্থলেই মরিয়ম মারা যায়। গত বছর ২৯শে মার্চ মাদারীপুরে মায়ের হাতে খুন হয় মাদকাসক্ত পুত্র। মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের চাপাতলি বড়মেহের গ্রামে ঘটেছিল এ ঘটনা। মাদকাসক্ত পুত্র ইমরান মাতব্বরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মা কুপিয়ে হত্যা করে তাকে। হত্যার পর মা মাকসুদা বেগম চিৎকার করে বলতে থাকেন এখন আমার ফাঁসি হলেও তা হাসিমুখে বরণ করে নেব। কারণ পুত্রের নির্মম নির্যাতনের চেয়ে ফাঁসিই আমার কাছে শ্রেয়। অপরদিকে মাদকাসক্ত পুত্রকে পুলিশে দেয়ার ঘটনা ঘটছে হরহামেশা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে। গতবছর ২৪শে অক্টোবর বগুড়ার শেরপুরে মাদকাসক্ত পুত্র আল ফারুকীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় তার স্কুলশিক্ষক পিতা এসএম আশাদুল্লাহ। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ৯ মাসের কারাদণ্ড দেয়। সে সময় শেরপুর পৌর শহরের স্যান্নালপাড়ার শিক্ষক এসএম আশাদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বিভিন্ন সময় তার মাদকাসক্ত ছেলেকে চিকিৎসা করে সুস্থ করা হয়েছে। কিন্তু নেশা ছাড়তে পারেনি। তাকে সুস্থ করার জন্য কয়েকবার ব্যবসা করতে পুঁজিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সেগুলো নষ্ট করেছে। তার অত্যাচারে পরিবারের সবাই অতিষ্ঠ। ঘটনার দিন তাকে গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছিল আল ফারুকী। পরে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে রক্ষা করে। না হলে হয়তো মারা যেতে হতো। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। গত বছর ২রা মার্চ নারায়ণগঞ্জ বন্দরের মিয়া চান তার পুত্র আলম চানকে পুলিশে সোপর্দ করে। অতিষ্ঠ মিয়া চান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আলম চান আগের দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তার কাছে মাদক সেবনের টাকা চায়। টাকা দিতে পারবো না জানালে আলম ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে ও তার মাকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করে। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশে খবর দেই। গতবছর ২৩শে সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের বিরলে মাদকাসক্ত পুত্রকে পুলিশে তুলে দেন পিতা। উপজেলার মানপুর গ্রামের বজ্রকুমার দাস মাদকাসক্ত পুত্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পুত্র অজিত কুমার দাস মিঠুকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বিরল থানা পুলিশ মাদকসেবী মিঠুকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। গত বছর ১৪ই জুন নওগাঁর পত্নীতলায় ২ মাদকাসক্ত পুত্রকে মরণ নেশা মাদকের কবল থেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় তাদের পিতা-মাতা। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পত্নীতলার বাসকোলা গ্রামের আব্দুর রহিমের পুত্র মেহেদি হাসানকে ৬ মাস ও আমবাটি গ্রামের নূর মোহাম্মদের পুত্র আনোয়ার হোসেনকে ২ মাসের কারাদণ্ড দেন। মাদকাসক্ত সন্তানদের নিয়ে ঘরে ঘরে চলছে গুমোট কান্না। পিতা-মাতা ও পরিবার জিম্মি মাদকাসক্ত সন্তানের কাছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে এমন কোনো কাজ নেই যা মাদকাসক্তরা পারেন না। ফলে সমাজে অনাচার বাড়ছে। অবনতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |