জাতীয় সংসদে পদ্মাসেতু প্রকল্প নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তোলায় বিশ্বব্যাংক ও ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে কথা হয়েছে । আইনমন্ত্রী বলেছেন এই মামলা করা সম্ভব। আর মামলার খরচ দেয়ার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। জাসদ নেতা মইনুদ্দীন খান বাদল বলেছেন, তিনি ও চট্টগ্রামের আরেক নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাদী হতে রাজি আছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রসিকতা করে পরে বলেছেন, তিনি আইনজীবী হতে রাজি আছেন।
কানাডার আদালত পদ্মাসেতু দুর্নীতি মামলাকে গালগপ্প বলে খারিজ করার পরদিন রবিবার জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সংসদ সদস্যদের প্রায় সবাই। জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা সংসদে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা, সরকারের বিরুদ্ধে দুর্ণাম ছড়ানো ব্যক্তিদের সংসদে তলব করে জবাবহিদি নেয়াসহ নানা দাবি জানান।
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গ
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এখানে আমরা সাক্ষী, তথ্য এবং এই মিথ্যা মামলার একটা উপাত্ত পেয়ে গেছি। এখানে মামলার উপাত্ত আছে, অপরাধ কী হয়েছে সেটাও ডিফাইন আছে, সাক্ষীও আছে। কেউ যদি আইনি ব্যবস্থা নিতে চায়, সে জন্য পথ খোলা আছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আই এম এ ব্রড অপটিমিস্ট। আমি বলতে চাই, এটার খারাপ দিকটা ভুলে গিয়ে আমি এটার ভালো দিকটা নেবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। এই মর্যাদার আসনটা রক্ষা করার জন্য আমরা যা যা দরকার, তাই করবো।’ বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠাতে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি করেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আনিসুল হক সাহেবকে বলবো, বিনা পয়সায় কাজ করতে হবে না। ফি আমি দেবো, আপনি কাজ করুন তাদের বিরুদ্ধে যারা মিথ্যা অযুহাত সৃষ্টি করেছে আমাদের বিরুদ্ধে।’
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘কানাডার রায়ের মাধ্যমে এই মামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা হয়ত কিছুটা তৃপ্তিবোধ করবেন। তারা নির্দোষ ছিলেন, সেটি আদালতে প্রমাণ হয়েছে। ভেবে দেখতে হবে কারা ছিল এর পেছনে, কতটা ক্ষতি তারা করেছে, যারা ক্ষতি করলো, তাদের জবাবহিহিতা কীভাবে আমরা নিশ্চিত করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবো।’
জাসদ নেতা মইনুদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘আমি চাটগাঁইয়া, যার নামে এত কথা হচ্ছে ইউনুস সাহেব, তিনিও চাটগাঁইয়া। স্বাভাবিকভাবে মুখে না বললেও চাটগাইয়া হিসেবে তার প্রতি আমার সফট কর্নার ছিল। কিন্তু যে অভিযোগগুলো এখন প্রমাণিত হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং আমি এই মামলার বাদী হতে রাজি আছি।’
বাদল বলেন, ‘চাটগাঁইয়ারা মাথামোটা হতে পারে, মাথা গরম হতে পারে, কিন্তু চক্রান্তকারী হিসেবে জীবনে নাম উঠেনি। বাংলাদেশ জানুক ঘটনা কী ঘটেছে।’
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব ও সংসদে তলবেরদাবি
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক এতোটা শক্তিশালী না, যে শক্তিকে পুঁজি করে তারা ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে উপহাস করতে পারে, সেই স্বাধীন দেশের মানুষকে অপমান করতে পারে, সেই শক্তি বিশ্বব্যাংকের নেই।’ তিনি বলেন, ‘কানাডার আদালতের রায় প্রমাণ করেছে, পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি। বরং আমরা বলতে পারি বিশ্ব ব্যাংক নিজেরাই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এডিবর রিপোর্টে বলা হয়েছে- পদ্মাসেতু হলে আমাদের জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হবে এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হবে। বিশ্বব্যাংকের মিথ্যা অভিযোগে সব যে আটকে গেলো, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমরা শুধু কথা বলে যাবো, এটা হতে পারে না। আপনাকে অনুরোধ করবো এখানে নিন্দা প্রস্তাব আনতে হবে। যেন আমরা বলতে পারি তারা ভুল বলেছিল, মিথ্যা বলেছিল।’
নাসিম বলেন, ‘যারা আমাদেরকে অপমানিত করেছে, আমাদেরকে ছোট করেছে, তাদেরকে পার্লামেন্টে ডাকতে হবে। এই পার্লামেন্টের সে ক্ষমতা আছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, কেন কী কারণে তারা অভিযোগ তুলেছিল। দেশে কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি আছে যারা পার্লামেন্ট কমিটিতে আসবে না, জবাবহিদি করবে না। তাদেরকে আসতে হবে। বলতে হবে, কেন এই অভিযোগ তারা করেছেন।’
মইনুদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘দেয়ার শুড বি অ্যা রেজুলেশন। অন্যায়ভাবে একটি জাতিকে অপমান করার সাজা কী হতে পারে, আই ক্যান নট কোয়ান্টিফাই। দেয়ার শুড বি অ্যা রেজুলেশন ফ্রম দ্য পার্লামেন্ট। এই ঔদ্ধত্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দেখানো উচিত না।’ তিনি বলেন, ‘দুই দিন পর এখানে ইন্টার পার্লামেন্ট ইউনিয়ন হবে। এই রেজুলেশন ইন্টার পার্লামেন্ট ইউনিয়নের প্রত্যেক সদস্যের কাছে আমরা ধরিয়ে দিতে পারি।’
‘বিশ্বব্যাংককে মাফ চাইতে হবে’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আজকে মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়েছে। পুনরুদ্ধার মানে কি, মানে সেদিন নষ্ট হয়েছিল। এই নষ্টের কারণ বিশ্বব্যাংক। আজ আমি এই সংসদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, এর জন্য বিশ্বব্যাংককে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মাফ চাইতে হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্রমন্তী দীপু মনি বলে, ‘যাদের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়েছে, তাদের কাছে বিশ্বব্যাংককে ক্ষমা চাইতে হবে… ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই সেতু হলে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ পুনরুজ্জীবিত হতো, আমাদের এই দেশ এগিয়ে যেতো। সেই দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এত মানুষের এত ক্ষতি, এত অসম্মান, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষের সম্মানকে ক্ষুন্ন করা, এতসব ক্ষতি যারা করেছে, তাদের বিচার হতে হবে।’
বিএনপির সমালোচনা
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় বিএনপি, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমের একটি অংশেরও সমালোচনা করা হয় সংসদে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বরের জনসভায় বলেছিলেন, এখানে দুর্নীতি হয়েছিল, তাই বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করেছে। … আজ তিনি কী বলবেন?’।
নাসিম বলেন, ‘তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছিল। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রেস কনফারেন্স করে এটা বলেছিলেন। আদালত আজ বলেছে এটা একটা গুজবের ওপর নির্ভর করে এই মামলা করা হয়েছে। বিএনপি যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছিল, আজ বলতে চাই মিথ্যা অভিযোগের জন্য খালেদা জিয়ার পদত্যাগ করা উচিত।’
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার এখন পদযুগল ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
জাসদ নেতা মইনুদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে টক শোতে, এখানে ওখানে বলতাম, বিএনপির মত একট দল থাকা উচিত। কিন্তু গতকাল বিএনপির যে রিঅ্যাকশন দেখলাম তাতে বুঝলাম, এই দশটি শেষ হয়ে গেছে। …কীভাবে তার দলের জেনারেল সেক্রেটারি বলেন, তখন এ রকম শুনেছিলাম বলে এমন বিবৃতি দিয়েছিলাম। এটাকে পাগলামো বলে না কি? এটা প্রাইড অব দ্য নেশনের সম্পর্ক। তারা সমস্ত জাতিকে তাদের আচরণ দিয়ে অপমানিত করেছে।’
দীপু মনি বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব বলছেন, কানাডায় কী রায় হলো তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। অথচ এই কানাডার মামলা দেখিয়েই তারা বলেছিলেন শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতিবাজ। তারা আজ কেন বলছেন, তার একটি কারণ আছে। নাইকো দুর্নীতি মামলায় কানাডার আদালতেই প্রমাণ হয়েছিল বিএনপির মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন। সেই কারণেই আজ বিদেশি আদালতের রায়ে কিছু যায় আসে না, তা বলছেন তারা।’
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ অনেকেই সংসদে বক্তব্য রাখেন।