পশ্চিম ও প্রাচ্যের দুটি দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। একটি বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি; আরেকটি উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার জন্য জন্ম থেকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি; অন্যদিকে ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ মানদণ্ডের বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ করতে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। এই পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ ছিল কূটনৈতিক। প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও তৎকালীন আরেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পাশে থাকায় সফল হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তো সপ্তম নৌবহর প্রায় পাঠিয়েই দিয়েছিল পাকিস্তানের হাত শক্তিশালী করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ভেটো দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটে। ৭১ এ শুধু পাকিস্তান পরাজিত হয়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হয়েছিল।

সম্মিলিত পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল নানামুখী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৩রা নভেম্বর  জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক অপশক্তি ভেবেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারবেনা। সামনের দিকে হাঁটতে পারবেনা। তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শুধু উঠে দাঁড়ায়নি; জোরে হাঁটতে হাঁটতে উন্নয়নের গলিপথ থেকে বেরিয়ে রাজপথে উঠে গেছে। এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে মানুষের বাধা মনে হয় না। আমাদের বাধা যেন আমরাই। দুর্নীতি না থাকলে অনেক আগেই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতো।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যারা পরিষ্কার ধারণা রাখেন না, তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-বিশ্বব্যাংকের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা আসছে কেন? যারা সাম্রাজ্যবাদের চর্চা সম্পর্কে জানেন, তারা বোঝেন এবং মানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্য কায়েম করা এবং বজায় রাখার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে কাজ করে এই বিশ্বব্যাংক। আমাদের দেশে বিশ্বব্যাংক যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ল্যাটিন আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোতে তেমন নয়। ভেনেজুয়েলার প্রয়াত মহান নেতা হুগো শাভেজ ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে সাহস জুগিয়ে একবার ঘোষণা করেছিলেন-‘বন্ধুরা, আমিই বিশ্বব্যাংক। আপনারা আমার কাছ থেকে ঋণ নেন’। শাভেজ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ নেয়া মানে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে সারা জীবনের জন্য নির্ভরশীল হওয়া। ঋণ দেবে সামান্য, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কল্যাণে ঋণের খবর প্রচার করবে ‘সাহায্য’, ‘অনুদান’ ইত্যাদি আধিপত্যবাদী প্রত্যয়ের মোড়কে। সরল পাঠক ধরে নিবে, বিশ্বব্যাংক ছাড়া চলা সম্ভব নয়। এভাবেই বিশ্বের অনেক দেশে নতজানু, পরনির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে।

শেখ হাসিনা সরকারের এখানেই সাফল্যের বিশালত্ব এবং গুরুত্ব। নতুন প্রজন্মের সামনে এক প্রাতঃস্মরণীয় নজির। পশ্চিমাদের গৃহপালিত মিডিয়া যেখানে আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে পরনির্ভরশীলতার বীজ বপন করে চলেছে, সেখানে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের বিজয় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছে মাথা নত করেনি। বিশ্বব্যাংকের কাছে মাথা নত না করা মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জীবিত রাখা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভেতরে আদর্শের চর্চার ঘাটতি এসে থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর শুরু করা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাংকের মত সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ারগুলো ব্যবহারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামান্যতম কার্পণ্য করবেনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাংক এদেশে তাদের নিজস্ব একটা গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে। এদের একজন আবার শান্তিতে নোবেলও পেয়েছেন। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম কৌশলে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ধর্মাশ্রয়ী অপশক্তির বাংলাদেশীয় এজেন্টদের মানুষ মোটামুটি চেনে। কিন্তু ‘সুশীল’ প্রত্যয়ের মুখোশে তৎপর অন্যদের মানুষ এখনো ঠিক মত চিনতে পারেনি।

সরকারের অনেক ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু সাফল্যগুলোকে মন ও মগজ দিয়ে অনুধাবন করে স্বীকৃতি প্রদানও আমাদের কাজ। যারা সারাজীবন কিছু না করেই নিজেদের কমরেড বলে পরিচয় দিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করেন, তাদের কাছে একটা প্রশ্ন-শেখ হাসিনার সরকার যখন বলেছিলেন, নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব, তখন আপনারা একটুও এগিয়ে আসেননি কেন? শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু ইস্যুতে যা করে দেখালেন, সেটা কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশাল বিজয় নয়? কে তাহলে আসল কমরেড? আমার মতে শেখ হাসিনাই আসল কমরেড। একজন প্রকৃত যোদ্ধা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031