ফুটপাথতো রয়েছেই। দৃষ্টি তাদের ডাস্টবিন আর ময়লার স্তূপে। দু’চোখ শুধু খুঁজে বেড়ায় ময়লার ভেতরে পড়ে থাকা পলিথিন, কাঁচের টুকরাসহ নানা জিনিস। সকাল শুরু হয় তার কুড়ানোর মধ্য দিয়ে। কাওরানবাজারে এসে পড়ে থাকা সবজিও কুড়ায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসব কুড়িয়েই তার দিন পার। এরপর তা নির্দিষ্ট জায়গায় বিক্রি করে কোনোদিন ৫০ টাকা কোনোদিন তারও বেশি নিয়ে তুলে দেয় মায়ের হাতে। নাম তার রবিন। বয়স ১০ বছর। একবছর বয়সে মা তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। আশ্রয় নেয় বস্তিতে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। কিছুদিন আগে কাওরানবাজার এলাকায় গড়ে ওঠা পথশিশুদের একটি অস্থায়ী স্কুলে ভর্তি করা হয় পিতৃহীন রবিনকে। কিন্তু কুড়ানোর নেশা তাকে ছাড়েনি। রবিন জানায় ‘এইভাবেই ভালা লাগে’। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের খাঁ পাড়ায়। মা আলেয়া বেগম কাজ করেন বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাসায়। এখানকার আরো অনেক শিশুর মতো রবিনও এখন ‘টোকাই’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ১০ বছরের আরেক শিশু সালাউদ্দিন। রাজধানীর শাহ্‌বাগ, সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক ও তার আশপাশ এলাকায় প্রায়ই দেখা যায় তাকে। ডান বা বাম কাঁধে থাকে নোংরা একটি চটের বস্তা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এলাকার উদ্যান, পার্ক ও সড়কে পড়ে থাকা খালি প্লাস্টিকের বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, টুকরা কাগজ কুড়ায় সে। সিলেট থেকে ঢাকায় এসে সেও ‘টোকাই’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাবা সেলিম মিয়া সিলেটে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মা রাবেয়া খাতুন সেখানকার এক চায়ের দোকানে চা বিক্রি করেন। সালাউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় সোহ্‌রাওয়ার্দী  উদ্যান সংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের ফটকের পাশে। সে জানায় স্কুলের গণ্ডিতে কখনোই পা পড়েনি তার। তার ভাষায় ঢাকায় ‘টুকাইয়া’ চলা যায়। ‘ঢাকায় আসার পর ভাঙারি ব্যবসায়ী জাফর মিয়া  কইছে তার লগে থাইক্যা টুকাইলে অনেক ট্যাকা দিব। এর লাইগ্যা তার লগেই থাকি। সারাদিন টুকাইয়া ৫০, ১০০ যা পাই তারে দিয়া দিই। আমারে এর অর্ধেক দেয়’। জানায় দিনে এলাকার আশপাশের ফুটপাতগুলোতে সস্তায় ভাত খেয়ে দিন পার করে দেয় সালাউদ্দিন। আর রাতে তাকে ঘুমাতে হয় সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে কোন গাছের নিচে, বেঞ্চিতে অথবা ফুটপাতে। মাথার নিচে থাকে ইট কিংবা কাপড়ের পুঁটলি।
টোকাইয়ের রাতযাপন হয় ব্যস্ত শহরের ফুট ওভারব্রিজের মেঝেতে, পার্কের বেঞ্চ কিংবা গাছের গুঁড়িতে, ফুটপাতের সড়কে, কখনো ঠেলা গাড়ি কিংবা কাঠের গুঁড়িতে, কংক্রিটের পাইপের ভেতর মাথার নিচে ইট কিংবা ময়লা কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে তা মাথার নিচে দিয়ে ঘুমাতে দেখা যায় টোকাইকে। টোকাইয়ে জীবন মানে যেখানে যেমন। টোকাইদের চোখ থাকে রাস্তার পাশে ডাস্টবিন, আর্জনা ও সড়কের ফুটপাতে। মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্ট কিংবা আবর্জনায় এটা সেটা খুঁজতে দেখা যায় তাকে। ফুটপাতে বা ব্যস্ত সড়কে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের পানির বোতল, কাঁচের টুকরো, বোতলের মুখ, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিন, ধূমপায়ীদের ফেলে যাওয়া খালি সিগারেটের প্যাকেট, পুরনো পত্রিকা বা কাগজের টুকরো মাথা নুইয়ে কুড়াতে ব্যস্ত দেখা যায় তাকে। সারা দিনের কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস তারা বিক্রি করে ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে।
কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের সজীব (১২)। হাইকোর্ট সংলগ্ন মাজারে কথা হয় তার সঙ্গে। সজীব জানায়, তার জন্মের সময়ই মা মারা যান। বাবা শহীদ মিয়া আরেকটি বিয়ে করেন। অনাদর আর অবহেলায় সৎ মায়ের সংসারে বেশিদিন টিকতে পারেনি সজীব। যে কারণে স্কুলেও নিয়মিত যাওয়া হয়নি তার। একসময় সড়ক ও ফুটপাতকেই বেছে নেয় ঘরবাড়ি হিসেবে। কখনো বাস, লেগুনার লাইনম্যান, কখনো রেস্টুরেন্টে পানি সরবরাহকারী- এভাবেই বেশ ক’বছর কাটিয়ে দেয় সে। কিন্তু মানুষের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা অপবাদ সইতে না পেরে একসময়ে সে নেমে পড়ে ফুটপাতের পাশে আবর্জনা থেকে এটা-সেটা কুড়ানোর কাজে। সজীবের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ সময় হাইকোর্টের মাজারেই এখন থাকে সে। সেখানে মাজারের কিছু কাজও করে দেয়। বিনিময়ে দুপুরের খাবারটা পাওয়া যায়। আগে ফুটপাতে থাকলেও এখন সে রাতে থাকে এই মাজারেই। মাজারই যেন তার ঘরবাড়ি। সজীব জানায়, কেউ আদর করে। আবার কেউ চুরিসহ এটা-সেটা অপবাদ দিয়ে মারধর করে। সে জানায়, ইস্কুলে যেতে খুবই ইচ্ছা করে তার। কিন্তু সেখানেও অনাদর আর অবহেলা। আমরা গরিব বইল্ল্যা স্কুলেও আমরারে কেউ আদর করে না। এর লাইগ্যা ইস্কুলেও যাই না’। ১০ বছরের ঝিনুন। বঙ্গবাজারের নাজিরাবাজারের আলুবাজারের ছোট্ট একটি ঘর তার ঠিকানা। ঝিনুন টোকাইয়ের কাজসহ নানা কাজে ব্যস্ত রাখে নিজেকে। ফুটপাতে মানুষের ফেলে দেয়া নানা সামগ্রী ও এটা সেটা কুড়িয়ে জমা করে সে। দিনের বাকি সময় কাটিয়ে দেয় হাইকোর্ট মাজারে। দুপুরের খাবারের পাশাপাশি ঝিনুনের রাতের ঠিকানাও এখন এই মাজার। ঝিনুন জানায় তার মা আরেকটি বিয়ে করার পর থেকেই তার দুর্ভাগ্যের শুরু। এরপর আর সংসারে মন টেকেনি। স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও পড়াতে আর মন বসেনি তার। এখন দিন চলে তার ভাষায় ‘যখন খুশি যেভাবে’।
রাজধানীর ডেমরা, যাত্রবাড়ী, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, দয়াগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন ভাঙারি ব্যসায়ীদের সঙ্গে রয়েছে টোকাইদের ব্যবসায়ীক যোগাযোগ। তারা জানায় প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য প্লাস্টিক বিক্রি করা যায় ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া কাগজ প্যকেট বিক্রি করা যায় ৫ থেকে ৮ টাকা কেজিতে। লোহা ও লোহা জাতীয় বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি  হয় ৫ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে। একজন টোকাইদের প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৫০ টাকা থেকে ২-৩শ’ টাকা পর্যন্ত।
১৫ বছরের রাসেল। ছোট বেলায় শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের ছয়গা বাংলাবাজার গ্রাম থেকে চলে আসে ঢাকায়। স্বপ্নের এই শহরে এখন তার দিন চলে এটা সেটা কুড়িয়ে। লিকলিকে শরীরের রাসেলের কাঁধে থাকে চটের ব্যাগ। এই কয়েক বছরে শাহবাগ, কাটাবন, বাংলামোটর এলাকায় ‘টোকাই’ হিসেবে তার পরিচিতি হয়ে গেছে। রাসেল জানায়, প্লাষ্টিকের বোতল, বোতলের মুখ, লোহার সামগ্রী, কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট যখন যেটা পাওয়া যায় তাই কুড়িয়ে নিয়ে চানখাঁরপুল এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। এভাবে প্রতিদিন তার আয় হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। ভাগ্য ভালো হলে এর বেশিও মেলে। রাতে সে ঘুমায় শাহবাগ এলাকার পদচারী সেতু অথবা সেখানকার ফুটপাতে। রাসেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার সমবয়সী অনেকেই এই এলাকায় টোকাইয়ের কাজ করে। তবে, এদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। রাসেলের ভাষায়- ‘এই জীবনডাই এহন ভালা লাগে। কোনো টেনশন নাই। সারাদিন টোকাইয়া যা পাই আমার ভালোই চলে, যেইখানে রাইত সেইখানেই কাইত।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031