কতটুকু সিইসি ও তার সহকর্মী কমিশনারদের ক্ষমতা ? তারা কি ইচ্ছে করলেই সাধারণ নাগরিকের মতো কথা বলতে পারেন? সাধারণ মানুষ খালি চোখে যা দেখেন তারাও কি সরাসরি তা দেখতে পান? দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বলা যায় তারা তা পারেন না। কারণ তাদের ভরসা করতে হয় অন্যদের ওপর। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর। কর্মকর্তারা যা লিখে দেন তা-ই তারা পড়ে যান শুধু। এ কারণেই আমজনতা যা দেখেন তারা তা দেখেন না। তারা উল্টোটা দেখেন। যাদের উপর ভরসা তাদের রিপোর্ট বিশ্বাস করেন। তা অকপটে দেশবাসীকে জানান দেন। সেই রিপোর্ট সত্য না মিথ্যা তাও যাচাই করার ক্ষমতা নেই
নির্বাচন কমিশনের। অর্থাৎ ইসি সবসময়ই কালো চশমা পরিহিত থাকে। দেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কতটুকু এ থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়। একটু বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার হবে। ২০০০ সালের ২৩শে মে সাবেক সচিব এমএ সাঈদ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান। তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এমএ সাঈদের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি জোট। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমএ সাঈদ সিইসি হলেন, সেই এমএ সাঈদই আওয়ামী লীগের বিরাগভাজন হয়ে গেলেন। একের পর এক নির্বাচন হতে থাকলো বিরাগভাজনের মাত্রাও বাড়তে থাকলো। সে সময় এমএ সাঈদের সঙ্গে কমিশনার হিসেবে ছিলেন শফিউর রহমান, একেএম মোহাম্মদ আলী ও এমএম মুনসেফ আলী। এরমধ্যে শফিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এমএ সাঈদের সঙ্গে শফিউর রহমানের মান-অভিমান প্রকাশ্যে চলে আসে। যা একসময় দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এ নিয়ে বেশ লেখালেখিও হয়। অপরদিকে সিইসি’র কর্মকাণ্ডে ক্ষমতায় থাকা বিএনপিও এমএ সাঈদের উপর চরম বিরক্ত। এরই মধ্যে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য কামাল বখত সাকী মারা যান। সেখানে উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আর সেই উপনির্বাচন সরজমিন দেখতে যাবেন সিইসি এমএ সাঈদ। সঙ্গী নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ক’জন কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা। সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে রওয়ানা। চল্লিশ মিনিট আকাশে উড়ার পর সাতক্ষীরার মাটি স্পর্শ করলো হেলিকপ্টার। জেলা প্রশাসন প্রস্তুত। প্রথমেই সিইসি ও তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে যাওয়া হলো সার্কিট হাউসে। সেখানে গার্ড অব অনার দেয়ার পর নাস্তা। এরপর তালা ও কলারোয়ায় সরজমিন কেন্দ্র পরিদর্শন। একের পর এক কেন্দ্র পরিদর্শন করে যাচ্ছেন সিইসি ও তার সঙ্গীরা। কিন্তু কোথাও সুষ্ঠু ভোট হচ্ছিল না। প্রকাশ্যে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগও শুনলেন সিইসি। বেলা আড়াইটায় কলারোয়ার এক কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল একটি বুথে ভোট পড়েছে মাত্র ১৩টি। শুনে সিইসি এমএ সাঈদ বললেন এটা নির্বাচনী রেকর্ড। ইতিহাস হয়ে থাকবে। এরপর আরো কিছু কেন্দ্র ঘুরে ঢাকায় ফেরা। কি আশ্চর্য! পরদিন সিইসি এমএ সাঈদ উপনির্বাচন নিয়ে ব্রিফ করলেন জেলা প্রশাসনের পাঠানো রিপোর্ট দেখে। যেখানে বলা হয়েছে নির্বাচন হয়েছে স্বচ্ছ। ভোটারের উপস্থিতিও ছিল ব্যাপক। তিনি যা দেখে এলেন তার কিছুই বলতে পারলেন না। কারণ কালো চশমায় তার নিজ চোখে দেখা সবকিছু ঢেকে দিয়েছে। অবশ্য এমএ সাঈদ বিষয়টি মেনেও নিতে পারেননি। তাইতো ২০০৪ সালের ১লা জুলাই হওয়া ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের আগে তিনি ছুটি নিয়ে চলে যান দেশের বাইরে। আর তখন সিইসি’র দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত কমিশনার শফিউর রহমান। আশায় বুক বাঁধে সবাই। এবার নির্বাচন জমবে ভালো। সে সময় বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত ঢাকা-১০ আসনের এমপি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান সংসদ থেকে পদত্যাগ করে যোগ দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এ। এর ফলে আসনটি শূন্য হয়ে যায়। উপনির্বাচনে বিএনপি মনোনয়ন দেয় মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। আর বিকল্পধারা বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন করেন মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। সে নির্বাচনে সকালেই কেন্দ্র দখল হয়ে যায়। বিকল্পধারার প্রার্থী আবদুল মান্নান বেলা ১১টায় প্রেস ব্রিফিং করে কেন্দ্র দখল, জাল জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। মেজর (অব.) মান্নানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ইসিতে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়ে আসেন। অবাক করা বিষয় ভারপ্রাপ্ত সিইসি শফিউর রহমান সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সামনে হাজির হন। তিনি অকপটে বলে যান, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়ায় তিনি সকল রাজনৈতিক দল, ঢাকা-১০ আসনের সকল ভোটার ও প্রার্থীদের কৃতজ্ঞতা জানান। ধন্যবাদ জানান নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তার এ বক্তব্যের পর সবাই তাজ্জব। নির্বাচনে কি হলো আর তিনি কি বললেন। আসলে সিইসি কে হলো না হলো তা ফ্যাক্টর নয়। ফ্যাক্টর হলো কালো চশমা। এ কালো চশমা খোলার ব্যবস্থা এ পর্যন্ত কেউই করেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১১ জন সিইসি বিদায় নিয়েছেন। আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১২তম সিইসি হিসেবে শপথ নেবেন একেএম নুরুল হুদা। তার সঙ্গে শপথ নেবেন আরো ৪ জন কমিশনার। নুরুল হুদা কমিশনের কাছে আশা করার কিছু নেই। কারণ এ কমিশনকেও অন্যসব কমিশনের মতো আমলাদের ওপর ভরসা করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনের পর আমলাদের দেয়া রিপোর্ট শুধু তারা পাঠ করবেন। আগের ধারাবাহিকতা তারা ধরে রাখবেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৭ই জুলাই প্রথম সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি মো. ইদ্রিস। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ সালের ৭ই জুলাই পর্যন্ত। ১৯৭৭ সালের ৮ই জুলাই দ্বিতীয় সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মাসুদ ১৯৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। চতুর্থ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সালের ২৪শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। পঞ্চম সিইসি হিসেবে আসেন বিচারপতি মো. আবদুর রউফ। তিনি ১৯৯০ সালের ২৫শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ষষ্ঠ সিইসি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি একেএম সাদেক। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৫ সালের ২৭শে এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত। সপ্তম সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পান সাবেক সচিব মো. আবু হেনা। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৬ সালের ৯ই এপ্রিল থেকে ২০০০ সালের ৮ই মে পর্যন্ত। অষ্টম সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পান এমএ সাঈদ। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ২০০০ সালের ২৩শে মে থেকে ২০০৫ সালের ২৩শে মে পর্যন্ত। নবম সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আসেন বিচারপতি এমএ আজিজ। তিনি ২০০৫ সালের ২৩শে মে থেকে ২০০৭ সালের ২১শে জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দশম সিইসি হিসেবে শপথ নেন ড. এটিএম শামসুল হুদা। তিনি ২০০৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দায়িত্ব পালন করেন কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ। তিনি ২০১২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। আর ১২তম সিইসি হিসেবে শপথ নেবেন আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারি একেএম নুরুল হুদা। এ পর্যন্ত যত কমিশনই এসেছে তারা বিতর্কমুক্ত হতে পারেননি। আর তাইতো বিদায় লগ্নে কাজী রকিব উদ্দীন বলেছেন, যে কমিশনই আসবে তারা আমাদের মতোই হবে। বিশিষ্টজন তাই বলছেন, যত স্বচ্ছ ব্যক্তিই সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নিক তিনি বিতর্কমুক্ত থাকতে পারবেন না। কারণ ইসিকে শক্তিশালী না করলে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারবেন না। কাজেই ইসি’র চোখ থেকে কালো চশমা খুলে ফেলতে প্রয়োজন তাদের নিজস্ব ক্ষমতা। নিজস্ব লোকবল। আমলানির্ভরতা থেকে ইসিকে বের করে আনলেই বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন দেখতে পারবে দেশবাসী।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |