বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন করা গেছে বলেই দেশের পরিস্থিতি এখন শান্তিপূর্ণ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন নির্বাচন নাহলে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হত।’
নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্তিতে বুধবার বিকালে কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন কাজী রকিব। এ সময় দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই সময় যদি নির্বাচন না করা যেতো, তাহলে দেশে অসাংবিধানিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সেই মুহূর্তে আমরা নির্বাচনটা করেছি বলেই দেশে আজ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
বিদায়ী সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় যারা আহত নিহত হয়েছেন, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, তাদের আত্মদানের কারণেই দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশানার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ এবং তিন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ ও জাবেদ আলী। আরেক কমিশনার শাহ নেওয়াজ নিয়োগ পান ১৬ ফেব্রুয়ারি। তার মেয়াদ শেষ হবে ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং সেদিনই কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে শপথ নেবে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন। গত সোমবার তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের মতো কাজী রকিবের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনও নিয়োগ পায় সার্চ কমিটির সুপারিশে। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তখনও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আজ বুধবার শেষ হলো কমিশনের মেয়াদ ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। আর নির্বাচন ঠেকাতে কয়েক মাসের টানা সহিংস আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানিও হয়। ভোটের আগের দুই দিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভোটের দিন হামলা হয় বিভিন্ন কেন্দ্রে, হত্যা করা হয় একজন প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে।
এর আগেই ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যরা, যাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। বাকি ১৫৬ আসনের মধ্যে কয়েকটিতে সেদিন ভোট শেষ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। পরে আবার ভোট নেয়া হয় কিছু কেন্দ্রে।
৫ জানুয়ারিও ওই নির্বাচন নিয়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘শত চেষ্টা করেও কয়েকটি দলকে যখন নির্বাচনে আনা যায়নি, তখন নির্বাচনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে আমরা নির্বাচন করেছি।’
বিএনপির ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না আসার পেছনে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বিদায়ী সিইসি বলেন, ‘আমাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। ইটস আ পলিটিক্যাল গেম, কেউ না এলে অন্য দল তো ফাঁকা মাঠে গোল দেবেই।’
গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তিন পর্ব, পৌরসভা নির্বাচন এবং কয়েকশ ইউনিয়নে নির্বাচনের গোলযোগ হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানিও হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে নির্বাচন কমিশনের। তবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘আমাদের কোনও ব্যর্থতা নাই। দায়িত্ব পালনের সময় আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সফলতার সঙ্গে আমারা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি।’
গত পাঁচ বছরের ঘটনাপ্রবাহের পর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছেন বিদায়ী সিইসি। বলেন, ‘ইদানিং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক ইতিবাচক বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশা করি, দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে।…একটি নির্বাচন কখনও লাথি মেরে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে সুষ্ঠু করা যায় না। এ জন্য গণতন্ত্রিক চর্চার উন্নয়ন দরকার।’
তার সময় নির্বাচন ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে রকিবউদ্দীন বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা মোটেই আমরা দুর্বল অবস্থায় নিয়ে যাইনি। আমাদের দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক যে অবস্থা সহিংসতার মাত্রা, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এমন।’
দায়িত্ব পালনকালে সরকারি দলের চাপ ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, আমাদের ওপর কোনও চাপ ছিল না। আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছি, আমরা কখনো কারও ফোন কল পাইনি। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে কখনো কেউ ফোন করেননি।’
কাজী রকিব বলেন, ‘আমাদের মেয়াদে আমরা একটি সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ ৭ হাজার ৪০৭টির বেশি নির্বাচন সম্পন্ন করেছি, ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সে সময় বিরোধীদলীয় নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিয়েছেন।’
গত পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশনের সফলতা তুলে ধরে বিদায়ী সিইসি বলেন, ‘আমরা পাঁচ বছর মেয়াদে স্মার্টকার্ড দিয়েছি, নতুন ভবন উদ্বোধন করেছি, ভোটারতালিকা হালনাগাদ করেছি, ছিটমহলবাসীদের ভোটার করেছি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা উপজেলায় নিয়ে যেতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী, শাহ নেওয়াজ, সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোকলেসুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।