চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দেশটির পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।গত বছরের ৮ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করেছেন। মোদির নোট বাতিল প্রকল্পের এসিড টেস্ট হবে এবার। তিনি বলেছেন জাতির মঙ্গলের জন্য তিনি নোট বাতিল করেছেন। নকল টাকা অচল হবে আর কালো টাকা বোতলে ঢোকাবেন। স্বর্গারোহণের জন্য যাত্রা করে নরকগামী হলেন কিনা, এবার বোঝা যাবে।
নরেন্দ্র মোদি সিন্ডিকেটের প্রধানমন্ত্রী। রতন টাটা, আম্বাসিরা সিন্ডেকেট করে তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। করপোরেট হাউসগুলো ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে জিতিয়ে আনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিলে। নরেন্দ্র মোদি উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সফল হয়েছেন বলে কেউ বিবেচনায় নেয় না।
অনুরূপ পরিস্থিতিতে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ যাবৎ বিহার, পশ্চিম বাংলা আর আসামের মতো রাজ্যগুলোতে নির্বাচন হয়েছে। আসামে বিজেপির নির্বাচনি জোট জিতেছে, বিহার ও পশ্চিম বঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য ছিল না। এখন হচ্ছে উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবসহ আরও তিনটি ছোট রাজ্যের বিধান সভা নির্বাচন।
উত্তর প্রদেশকে মিনি ভারত বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিও তিন বছর পার করেছেন। তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার গঠন করেছিলেন। কোনও কোয়ালিশন দলেরও মন রক্ষা করে চলতে হয়নি। তিনি ভারতকে কী দিতে পেরেছেন, তার বুঝ যা পাওয়ার ভারতবাসী পেয়েছেন। সুতরাং এবারের বিধান সভাগুলোর নির্বাচনে তার একটা প্রতিফলন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
উত্তর প্রদেশে ভোট যুদ্ধটা হবে ত্রিমুখী। বিজেপি, বহুজন সমাজ পার্টি আর সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস জোট। মায়াবতি তার ৪০৩ জন বিধায়কের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন এবং তাদের নামও ঘোষণা করেছেন। বিজেপি তাদের ১৪৯ জনের নাম ঘোষণা করেছেন। বিজেপির মনোনয়ন নিয়ে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে। কংগ্রেস থেকে লোক বাগানো আর মায়াবতির বিদ্রোহীদের দলে নেওয়া এ নিয়ে বিজেপি ব্যস্ত।
কংগ্রেসও সমাজবাদী পার্টি এখনও মনোনয়ন চূড়ান্ত করেনি। তাদের সঙ্গে লোকদল, লালু প্রসাদের জনতা দল আর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশের জনতা দলও আসতে পারে। অনুরূপ ছকে যদি জোট করা যায় তবে বিহারের মতো মহাজোট রূপ নিয়ে উত্তর প্রদেশেও জমজমাট নির্বাচন হবে। অখিলেশ যাদবই হবেন এ জোটের মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী। কংগ্রেসের প্রার্থী শিলা দীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থিতা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করেছেন। অখিলেশ গত পাঁচ বছর উত্তর প্রদেশের মতো বিশাল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার সযত্ন প্রয়াসের কারণে অখিলেশের সাফসুতরো ভাবমূর্তি বহাল রয়েছে। তার সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার সুনাম রয়েছে। তিনি বহু কল্যাণকামী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এ নির্বাচনে যার ফসল তিনি প্রত্যাশা করতে পারেন। অখিলেশের বাবা মোলায়েম সিং যাদব হচ্ছেন সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দুই দুই বার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। এবারের নির্বাচন নিয়ে বাবা-ছেলের মাঝে বিরোধ ভারতীয় রাজনীতিতে খুবই আলোচিত বিষয়।
তাদের সমাজবাদী দলের প্রতীক হচ্ছে সাইকেল। প্রতীকের বিরোধ নিয়ে উভয়ে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। দলের অধিকাংশ বিধায়ক অখিলেশের পক্ষে ছিলেন এবং তারা সে বিষয়টা দলবদ্ধভাবে নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন অখিলেশকে সাইকেল প্রতীক বরাদ্ধ করেছেন এবং সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্বে অখিলেশের দাবি আইন সম্মত বলেও নির্বাচন কমিশন স্বীকার করেছেন। এখন সমাজবাদী পার্টি অখিলেশেরই সম্পত্তি। তার বাবা বিরোধের পরও সব সময় দলের বিরোধের কথা অস্বীকার করেছেন এবং নির্বাচন কমিশনে বিরোধের বিষয়টা এবং প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে মোলায়েম সিং যাদব কোনও গুরুতর ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি।
বিজেপি বলেছে এটা পিতা পুত্রের নাটক। আসলে অখিলেশও তার বাবার বিরোধের মাঝে অমর সিং ও তার চাচা শিবপাল যাদব তলিয়ে গেছেন। মূলত বাবা-ছেলের বিরোধ ছিল শিবপাল যাদব ও অমর সিংকে নিয়ে। অখিলেশ প্রতীক বরাদ্দের পরও তার বাবা মোলায়েম সিং যাদব-এর কাছে গিয়ে দেখা করেছেন। মোলায়েম সিং যাদব নাকি এ সাক্ষাতের সময় মনোনয়নের জন্য তার ৩৯ জন প্রার্থীর নামের একখানা তালিকা অখিলেশের হাতে দিয়েছেন। সেখানে নাকি তার ভাই শিবপাল যাদবের নাম নেই। তবে অখিলেশ ১১ই ফেব্রুয়ারির প্রথম দফা নির্বাচনের জন্য ১৯১ জন প্রার্থীর যে তালিকা চূড়ান্ত করেছেন তাতে তিনি তার চাচা শিবপাল যাদবকে যশবন্তনগর থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
মোলায়েমের বয়স ৭৭ বছর। পাল্টাপাল্টির নির্বাচন করার বয়স এখন আর তার নেই। সর্বোপরি অখিলেশ তার ঔরশজাত সন্তান। হয়ত বা দেখা যাবে যে মোলায়েম সিং যাদব অখিলেশের নির্বাচনি প্রচারণায়ও শামিল হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সমাজবাদী পার্টির যে পোস্টার বের হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বাবা-ছেলের ফটো তাতে ছাপানো হয়েছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রিয়াঙ্কা ও অখিলেশের স্ত্রী এবারের নির্বাচনে সম্মিলিতভাবে প্রচারণা চালাবেন। কংগ্রেস গত দুই মাস রাজ্যব্যাপী জোরদারভাবে প্রচারণা ও সাংগঠনিক কাজ করেছে। কংগ্রেস প্রাচীন সংগঠন গত দু-মাসের সাংগঠনিক কাজকর্মে তাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সমাজবাদী পার্টিও উত্তর প্রদেশে সাংগঠনিকভাবে শক্ত। জাতপাতের সমীকরণে যাদবেরা সমাজবাদী পার্টিরই লোক। ১৯% মুসলিম ভোট তারা কখনও মায়াবতীর পক্ষে অবস্থান নেয় কখনও সমাজবাদী পার্টির পক্ষে থাকে। তবে তারা কখনও বিজেপির পক্ষের ভোটার নয়।
বিজেপির পক্ষে এবার হিন্দু ভোট একরোখা করে তোলাও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যদিওবা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ধর্মের নামে বা জাতপাতের নামে ভোট চাওয়াকে নিষেধ করেছেন তবে নিম্নজাতের হিন্দুরা মায়াবতী এবং অখিলেশের মাঝেই ঘুরপাক খাবেন।
আরএসএস-এর কর্মীরাই বিজেপির কর্মী। উত্তর প্রদেশে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বিজেপি-আরএসএস। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় যে উত্তম ফল নিশ্চিত করতে পেরেছিল, এবার বিরাজমান পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে সে ফল প্রত্যাশা করা কখনও সম্ভব হবে না।
বিজেপির জন্য উত্তর প্রদেশের বিধান সভার নির্বাচন কঠিন পরীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদি আর অমিত শাহ যদি রাজ্য সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে না পারে দলের মাঝে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির মাঝে সিট ভাগাভাগি চূড়ান্ত হয়েছে। এলাবাদে প্রিয়াঙ্কা ও অখিলেশ বৈঠক করে বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন। কংগ্রেসকে ১০৫ সিট দেওয়া হয়েছে। ২৯৮ সিট রয়েছে সমাজ পার্টির জন্য। লালু প্রসাদ যাদব আর নীতিশ কুমারের দল যদি জোটে যোগ দেয় এবং লোকদলও যদি সম্মত হয়, তবে বিহারের সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং হরিয়ানার সীমানায় হয়ত সমাজবাদী দলকে আরও কয়েকটা সিট ছেড়ে দিতে হবে।
অখিলেশ মনোনয়নের যে তালিকা চূড়ান্ত করেছেন, তাতে নাকি কোনও মুসলিম প্রার্থী নেই। উপরন্তু অখিলেশ মুসলমানদের নাকি বেয়াদব বলে আখ্যায়িত করেছেন। গরুর মাংস রাখার মিথ্যা অজুহাতে এক মুসলমান পরিবারের কয় সদস্যকে যখন বিজেপির এবং আসএসএসের কর্মীরা হত্যা করে তখন কিন্তু অখিলেশ ওই এলাকা সফরও করেননি। অবশ্য রাহুল গান্ধি তখন উপদ্রুত এলাকা সরজমিনে সফর করেছিলেন। মায়াবতীর মনোনয়নের নিম্নবর্ণ, ঠাকুর আর মুসলমান প্রার্থীর মাঝে সুন্দর সমন্বয় নাকি করা হয়েছে। তাজ করিডোরের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে মায়াবতীর ক্রেডিবিলিটি ক্রাইসিস রয়েছে, তা যদি সামাল দিয়ে উঠতে পারে, তবে মুসলিম ভোটের জোরে তিনি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসবেন এবং সরকার গঠনের মতো সংখ্যাও পেয়ে যেতে পারেন।
অমিত শাহ আর নরেন্দ্র মোদি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের ওপর। তারা জনসমাবেশের কাজও আরম্ভ করেছেন। উত্তর প্রদেশে এবারের নির্বাচনে জিততে না পারলে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গুরুতর অসুবিধার সম্মুখীন হবেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিল গোবলয়ে আর গোবলয়ের মুখ্য রাজ্য হচ্ছে উত্তর প্রদেশ। উত্তর প্রদেশে লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৮০ জন।
পাঞ্জাবে বিজেপি-আকালি জোট আর কংগ্রেসের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। লোকসভায় সিট পেলেও আম-আদমি পার্টি সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। উত্তরাখণ্ডে সম্ভবত কংগ্রেস ফিরে আসবে। মনিপুর আর গোয়ায় স্থানীয় দলগুলোই সরকার গঠন করার সম্ভাবনা বেশি।