তিন কোটিরও বেশি মানুষ করযোগ্য আয় করেও কর দিচ্ছেন না। আয়কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও আয়কর দেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী করের আওতায় এসেছেন ২৬ লাখ ১৯ হাজার ২৯ জন। অথচ কর দিয়েছেন এর অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ টিআইএন নেওয়া ব্যক্তিদের ৫০ ভাগই কর দিচ্ছেন না। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এদের মধ্যে প্রায় ৩ কোটিরও বেশি সামর্থ্যবান মানুষ করযোগ্য আয় করছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে হলে সামর্থ্যবান সবাইকে করের আওতায় এনে আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য অবশ্য উপযুক্ত পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। যাতে নিজ উদ্যোগেই তারা টিআইএনের আওতায় আসেন এবং আয়কর রিটার্ন জমা দেন।
এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইটিআইএন বৃদ্ধি হচ্ছে মানেই করতাদা বাড়ছে এমনটি নয়। এদের একটা অংশ কর দেওয়ার জন্য ইটিআইএন খোলেননি, খুলেছেন মূলত তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু ২৬ লাখ টিআইএনধারীর একটা বড় অংশ পটেনশিয়াল করদাতা নয়, যারা কিনা সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা বা পাঁচ হাজার টাকা কর দেয়। এ কারণে করের পরিমাণ বাড়ছে না।’
তিনি বলেন, ‘যারা কর দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন তারা যাতে আনন্দের সঙ্গে কর দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা এনবিআরকেই করতে হবে। এ জন্য আগে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সৎ হতে হবে। যখন মানুষ জানবে কর দিতে গেলে হয়রানি হতে হয় না, তখনই মানুষ আনন্দের সঙ্গে কর দিতে চাইবে।’
এনবিআরের নিজস্ব গবেষণাতেও দেখা গেছে, টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও করের আওতা বাড়ানো যায়নি। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে এনবিআর সদস্য রেজাউল হাসান বলেন, ‘দেশের মোট জনগোষ্ঠী বা জাতীয় আয়ের তুলনায় করদাতার সংখ্যা অত্যন্ত কম।’

জানা গেছে, বর্তমানে মোট আয়কর আদায়ের ৭০ শতাংশ আসে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ ব্যক্তিশ্রেণির কর। যদিও সংখ্যার দিক থেকে ব্যক্তিশ্রেণি করদাতার সংখ্যাই বেশি।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘মানুষ আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ কর দিচ্ছে। কিন্তু সেবার মান আগের চেয়ে বাড়েনি।এক টাকার কর দিতে গিয়ে এখনও তিন টাকার হয়রানির শিকার হতে হয়।’ এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করদাতাদের হয়রানির অভিযোগ আগের চেয়ে কমেছে। আমরা এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। মানুষ এখন আগ্রহের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়।’

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আয়করের মাধ্যমে এনবিআর আয় করেছে ৫৪ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এই ৫৪ হাজার কোটি টাকার ৭০ ভাগই দিয়েছে কোম্পানি, যাকে করপোরেট কর বলা হয়। বাকিটা এসেছে ব্যক্তি খাত থেকে।

আয়কর আইন অনুযায়ী বর্তমানে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া ও যাতায়াত ভাতা বাদ দিয়ে বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি হলে তাকে প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে।

আবার  প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কয়েকটি খাত থেকেই আদায় বেশি হচ্ছে। করপোরেট কর হিসেবে কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর দেয় ব্যাংক খাত। মোট কর আদায়ের ৩০ ভাগই আসে এই খাত থেকে। তার পরই আছে বীমা, মার্চেন্ট ব্যাংক, লিজিংসহ অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও টেলিযোগাযোগ খাত। মোবাইল কোম্পানির মধ্যে গ্রামীণফোন মোটা অঙ্কের কর দেয়। বেশি কর দেয় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ফার্মাসিউটিক্যালস খাত।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ১ জুলাই ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন শুরুর পর থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ ডিজিটের টিআইএনধারীর সংখ্যা দাড়িয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার ২৯ জনে। এদের মধ্যে কর দিয়েছেন মাত্র সাড়ে ১১ লাখ (২০১৬-১৭ করবর্ষের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত)।

জানা গেছে, ১৯৯২ সালের আগে জেনারেল ইনডেক্স রেজিস্ট্রার নম্বর বা জিআইআর এর মাধ্যমে আয়কর দিতেন করদাতারা। তখন কর দিতেন হাতে গোনা কিছু মানুষ। ১৯৯২ সালে জিআইআর বাতিল করে ১০ ডিজিটের আয়কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পর দেখা যায়, করদাতা না বাড়লেও টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি একই ব্যক্তি ২০ থেকে ২৫টি টিআইএন-এর মালিক হয়েছেন। এ কারণে ১০ ডিজিটের এই টিআইএন বাতিল করে ১২ডিজিটের ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ই-টিআইএন শুরুর সময় (২০১৩ সালে) ১০ ডিজিটের টিআইএনধারী ছিলেন ৩২ লাখের কাছাকাছি। তবে এদের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়ার সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ২০১১ সাল নাগাদ টিআইএনধারী ছিলেন ২৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ রিটার্ন জমা দিতো। বাকি ৬১ শতাংশ টিআইএন ছিল ভুয়া।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর (২০১৬) পর্যন্ত ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার ২৯ জনে। এর মধ্যে করদাতার সংখ্যার ১২ লাখের ঘরে। আর গত জুন পর্যন্ত টিআইএনধারীর সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে ৮ লাখ ১৫ হাজার ৪৮৩ জন করদাতা রিটার্ন দাখিল করেন। এনবিআরের আয়কর আদায় হয়েছিল ১ হাজার ৮৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে আয়কর বাড়াতে বেশ জোর দিয়েছিল এনবিআর। জেলা-উপজেলায় মেলার পাশাপাশি অনলাইনেও রিটার্ন জমা চালু করা হয়।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ কর বর্ষে সাড়ে ১১ লাখ করদাতা রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এই সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৪০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের কাছ থেকে মোট আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া আরও ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৯ জন করদাতা রিটার্ন দাখিলের জন্য সময় বাড়াতে আবেদন করেছেন। এই হিসাবে গত কর বর্ষের মতো এই করবর্ষেও ১৩ লাখ করদাতা কর দিচ্ছেন।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, এবার সারা দেশের বিভিন্ন কর সার্কেলে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯০২ জন করদাতা তাদের আয়কর বিবরণী দাখিল করেছেন। এছাড়া, ১ থেকে ৭ নভেম্বর আয়কর মেলায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯৮ জন করদাতা রিটার্ন দাখিল করেন। আর আয়কর সপ্তাহে জমা দেন (নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ) ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৯৭ জন।

উল্লেখ্য, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি)  হিসেবে, দেশে আয়কর দেওয়ার যোগ্য মানুষ আছেন ৮০ লাখেরও বেশি।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশালসংখ্যক মানুষ আয়করের বাইরে থেকে যাওয়ার কারণে উন্নয়নের ক্ষেত্রে একদিকে অর্থসংকট তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের ওপরও নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031