বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে ব্যাংক ঋণ প্রদানে অস্বাভাবিক কড়াকড়িতে শিল্পায়নসহ সব ধরনের। এতে ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠেছে। সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতসহ সব ধরনের ব্যাংক হিসাবে সুদের হার কমিয়েও ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি গ্যাস বিদ্যুতের অভাবও অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা না কাটলে স্বাভাবিক ব্যাংকিং অসম্ভব হয়ে উঠবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি মিলে ৬০টির মতো ব্যাংক রয়েছে। সর্বাধুনিক নানা প্রযুক্তি সুবিধা নিয়ে ব্যাংকগুলো গড়ে উঠছে। এসব ব্যাংকে দেশের লাখ লাখ আমানতকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে জমার পাশাপাশি বিদেশ থেকে প্রেরিত কোটি কোটি টাকার রেমিটেন্সও ব্যাংকে জমা হচ্ছে। বৈধ অবৈধ যেভাবে টাকাগুলো দেশে আসুক না কেন প্রবাসীদের প্রেরিত কোটি কোটি টাকার শেষ গন্তব্য হচ্ছে দেশের ব্যাংক। প্রতিটি ব্যাংকেই জমছে টাকা। এসব জমার বিপরীতে গ্রাহকরা ব্যাংকগুলো থেকে সুদ পাচ্ছেন। পেনসনভোগীসহ দেশের অনেক বড় একটি অংশ এই সুদ দিয়ে সংসার চালান। আবার অনেকেই কোন ধরনের ঝুঁকিতে না গিয়ে নিজের সারা জীবনের অর্জিত অর্থ ব্যাংকে রাখেন। এই অর্থের সুদ দিয়ে বহু মানুষই সংসার চালান। অপরদিকে ব্যাংকগুলো যে পরিমান সুদ দিয়ে গ্রাহক থেকে টাকা জমা নেন তার থেকে বেশি সুদে এগুলো বিনিয়োগ করে নিজেরা লাভবান হন। কিন্তু গত বছর থেকে ব্যাংকগুলো হঠাৎ করে বড় ধরনের বেকায়দায় পড়ে। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেয়ায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠে। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার এই প্রবণতায় ব্যাংকগুলো শিল্প ঋণ প্রদান অনেকটা বন্ধ করে দেয়। এতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীরাই কেবল নয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও আর ঋণ পাচ্ছেন না। দেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যৌথ (দেশি–বিদেশি) বিনিয়োগ হচ্ছে না।
অপরদিকে বিভিন্ন ব্যাংক পণ্য আমদানির এলসিও কমিয়ে দেয়। স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি বাণিজ্য। বিভিন্ন ব্যাংক যেসব আমদানিকারকদের অফিসে গিয়ে একটি এলসি খোলার জন্য তদবির করতো সেইসব ব্যাংকে গিয়ে আমদানিকারকদেরকেই উল্টো দেন দরবার করতে হচ্ছে। এতেও কোন সুফল মিলছে না। ব্যাংকগুলো অতি সতর্ক হয়ে উঠায় ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হু হু করে বাড়তে থাকে। গতকালের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাংকে অলস টাকার পরিমান ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠার সাথে সাথে ব্যাংকের জামানতের উপর সুদের হার দ্রুত কমে যায়। বর্তমানে কোন ব্যাংকই সাত শতাংশের উপর সুদ দিচ্ছে না। টাকার অংক বড় হলেই শুধু ৭ শতাংশ সুদ প্রদান করা হচ্ছে। টাকার অংক দুচার পাঁচ লাখে নেমে আসলে সুদের হার ৫ শতাংশে নেমে আসছে। আবার দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী আমানতে (ফিক্সড ডিপোজিট) ৫ থেকে ৭ শতাংশ দেয়া হলেও স্বল্পকালীন বিনিয়োগে সুদের হার সাড়ে তিন থেকে চার শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অনেক ব্যাংকই জামানত নিতে চাচ্ছে না। বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনক বলে উলেহ্মখ করে একাধিক ব্যাংকার গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেছেন, পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রথমত আমরা ঋণ দিতে পারছি না। একটি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ঋণ দিলেও সর্বোচ্চ সুদ পাওয়া যাচ্ছে ১০/১২ শতাংশ। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা খরচ বাদ দিয়ে আমানতকারীরা ৫/৭ শতাংশ মুনাফা দেয়া কঠিন। এতে করে একটি বিশাল জনগোষ্ঠি মারাত্মক রকমের সংকটে পড়েছেন বলে স্বীকার করে ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদের উপর নির্ভর করে সংসার চালান এমন জনগোষ্টি সত্যি সত্যি কষ্টে আছেন।
ব্যাংকগুলোও ভালো নেই বলে উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, অলস টাকা সচল করতে পলিসি দরকার। এ ধরনের কোন পলিসি চোখে পড়ছে না। মানুষ বিনিয়োগ করছে না। পরিস্থিতি উত্তরণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবলমাত্র সরকারিভাবেই তা নেয়া সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে গতকাল বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠার প্রবণতা শুরু হয়েছে আরো আগে। বিনিয়োগ না থাকার ফলে এর পরিমান কেবল বাড়ছে। তিনি বলেন, রেমিটেন্স প্রবাহ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বিদেশ থেকে টাকা আসছে। অথচ বিনিয়োগে গতি নেই। তাই টাকা জমে যাচ্ছে। এতে সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।