ভুল পদ্ধতিতেই! নগরীর সরকারি স্কুলগুলোর নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে গত বুধবার চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন এ তালিকা প্রকাশ করে। যা বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদীসহ স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়। তবে তালিকা তৈরিতে পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রকাশিত ওই ফলাফল বাতিল করেছে জেলাপ্রশাসন। চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবর্তীতে পুনরায় এ তালিকা/ফলাফল প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছেন জেলাপ্রশাসক।
প্রসঙ্গত, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রস্তুতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) দুটি পদ্ধতি নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মাউশি’র পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর মো. এলিয়াছ হোসেন স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তি গত ৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ফলাফল প্রস্তুতের দুটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। প্রথমটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতি। শূন্য আসনের তুলনায় আবেদনকারীদের মধ্যে একই জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা সমান অথবা কম হলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ফলাফল প্রস্তুতের কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে জেএসসি বা জেডিসির ফলাফলের ভিত্তিতে টেলিটক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তালিকাই প্রকাশযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। অন্যদিকে, শূন্য আসনের তুলনায় আবেদনকারীদের মধ্যে একই জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করে ফলাফল প্রস্তুতের কথা বলা হয়। এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে টেলিটক কতৃক প্রস্তুতকৃত ফাইল বা তালিকাটি সংশিহ্মষ্ট শিক্ষাবোর্ডে সরবরাহ করার কথা বলা হয়। শিক্ষাবোর্ড সমান জিপিএ প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে জেএসসি/জেডিসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের একটি মেধাক্রম তৈরি করবে। আর শিক্ষাবোর্ডের এই মেধাক্রম ব্যবহার করেই ভর্তি কমিটিকে ফল প্রকাশের কথা বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
মাউশি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী– চট্টগ্রাম মহানগরীর সবকয়টি সরকারি স্কুলে নবম শ্রেণি ভর্তিতে মনোনীতদের তালিকা প্রস্তুতে শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা। শূন্য আসনের তুলনায় সমান জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ধারাবাহিক ভাবে বিগত বছরগুলোতে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই (নবম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে) এ তালিকা প্রকাশ হয়ে আসছে চট্টগ্রামে। মাউশি’র পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর মো. এলিয়াছ হোসেনও বলছেন– শূন্য আসনের তুলনায় একই জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে সেক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে এবারের তালিকা প্রস্তুতে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই প্রস্তুত করা হয়েছে এবারের তালিকা। যা গত বুধবার প্রকাশ করে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন। এর ফলে শুরশুর দিকের আবেদনকারীরাই কেবল এ তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু সমান জিপিএ পেয়েও শেষের দিকে আবেদন করা কোন শিক্ষার্থী এ তালিকায় ঠাঁই পায়নি। সবকয়টি স্কুলের ক্ষেত্রেই ঘটেছে এ ঘটনা। এছাড়া জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলেও ফল পুনঃনিরীক্ষায় আবেদনের সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। আর পুনঃনিরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে এ তালিকা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। কারণ, পুনঃনিরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থীর জিপিএ উন্নতিসহ ফল পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। যার কারণে প্রতি বছর জেএসসি/জেডিসি’র পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশের পরই নবম শ্রেণি ভর্তিতে মনোনীতদের এ তালিকা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার মানা হয়নি সেই নিয়মও। জেএসসির পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশের আগেই তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন।
যা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন– এই তালিকা তৈরিতে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। ভুল পদ্ধতিতে তালিকাটি প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হয়েছে। আর এই ভুল পদ্ধতির কারণে সমান জিপিএ পেয়েও অনেক যোগ্য শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়েছে।
জেলাপ্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী– কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ১৪০টি শূন্য আসনের বিপরীতে আবেদন করে ১ হাজার ৫৬৮ জন ভর্তিচ্ছু। আর ৯০০০০০১ থেকে শুরু হয়ে এদের রোল নম্বর সিরিয়াল দেয়া হয় ৯০০১৫৬৮ পর্যন্ত। জেলাপ্রশাসন কতৃক বুধবার প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়– এই সিরিয়ালের প্রথম ৩৩২ জনের মধ্য থেকেই মেধা তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ৩৩২ পরবর্তী রোল নম্বরধারী একজন শিক্ষার্থীও (কোটা বাদ দিয়ে) এ তালিকায় ঠাঁই পায়নি। একই ঘটনা সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের ক্ষেত্রেও। স্কুলটির নবম শ্রেণির ১৪০টি শূন্য আসনের বিপরীতে আবেদন পড়ে ১ হাজার ২৬০টি। কিন্তু আবেদনকারীদের শুরুর দিককার ৬২৬ সিরিয়াল থেকেই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ৬২৬ সিরিয়াল পরবর্তী রোল নম্বরধারী কোন শিক্ষার্থীর (কোটা বাদ দিয়ে) তালিকায় জায়গা হয়নি। শুধু এই দুই স্কুলে নয়, নবম শ্রেণিতে ভর্তি নেয়া নগরীর আটটি স্কুলের ক্ষেত্রেই ঘটেছে একই ঘটনা। কলেজিয়েট স্কুলে আবেদন করা এক শিক্ষার্থীর বাবা পীযূষ কান্তি ভদ্র অভিযোগ করে বলেন– আমার ছেলে এবার গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। আমরা আবেদন করেছি একটু শেষের দিকে। যার কারণে আমার ছেলের রোল নম্বরের সিরিয়াল একটু পিছনের দিকে। ফলে তালিকায় আমার ছেলের ঠাঁই হয়নি। শুরশুর ৩৩২ জন থেকেই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। ৩৩২ পরবর্তী সিরিয়ালের কোন শিক্ষার্থী তালিকায় আসেনি। কে কখন আবেদন করলো সেটার ভিত্তিতে কেন ফলাফল প্রস্তুত হবে, এমন প্রশ্ন তুলে ভুল পদ্ধতিতে প্রস্তুত ও প্রকাশিত এই ফলাফল বাতিলের দাবি জানান এই অভিভাবক। শুধু এই অভিভাবক নন, গতকাল আজাদী অফিসে এসে অনেক অভিভাবক এ দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে গতকাল রাতে কথা হলে মাউশি’র পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর মো. এলিয়াছ হোসেন আজাদীকে বলেন, ‘যেহেতু আসনের তুলনায় সমান জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি– সেহেতু অবশ্যই শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যদি সেটি না হয়ে থাকে তবে ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে ফলাফলটি পুনরায় প্রকাশ করতে হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন মাউশি’র এই কর্মকর্তা।’
এদিকে, টেলিটক কতৃপক্ষের পদ্ধতিগত ক্রুটির কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি সরকারি স্কুলগুলোর ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম তদারককারী কর্মকর্তা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, টেলিটক কতৃপক্ষই ভুল পদ্ধতিতে আমাদের এ তালিকা করে দিয়েছেন। আমরা শুধু প্রকাশ করেছি মাত্র। তবে ভুলের বিষয়টি পরে নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানান অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক।
আর প্রকাশিত ফলাফল প্রস্তুতে পদ্ধতিগত ভুলের কথা স্বীকার করে জেলাপ্রশাসক গতকাল রাতে আজাদীকে বলেন, প্রকাশিত ফলাফল প্রস্তুতের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণের কথা সেটা অনুসরণ করা হয়নি। অন্য একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। যা সঠিক হয়নি বলে আমরা জানতে পেরেছি। যার কারণে বুধবার প্রকাশিত ওই ফলাফল আমরা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোন যোগ্য শিক্ষার্থী যাতে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই পরবর্তীতে এ ফলাফল পুনরায় প্রকাশ করা হবে বলেও জানান জেলাপ্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন।
উল্লেখ্য, নগরীর মোট ৯টি মাধ্যমিক সরকারি স্কুলের মধ্যে আটটি স্কুলে (ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া) এবার নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই আট স্কুলে এবার মোট ৭৫০ জন ছাত্র–ছাত্রীর নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ রয়েছে।