প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না উল্লেখ করে বলেছেন, তার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এভাবে হত্যা করা, এটা কখনই মেনে নেয়া যায় না। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি- যারা এর সঙ্গে জড়িত, যেকোনোভাবে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে গণভবন থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রংপুর বিভাগের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় শিক্ষক, অভিভাবক, মসজিদের ইমামসহ সকল শ্রেণি-পেশার জনগণকে জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের সর্বস্তরের জনগণ সকলের কাছে আমার একটাই আহ্বান থাকবে- বাংলার মাটিতে এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের স্থান যেন না হয়। এর আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হয়ে ‘ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’-এর ভবন (দশ তলা) এবং ১০০০ আসনের ‘শেখ হাসিনা ছাত্রী হল’-এর (দশ তলা) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। ভিডিও কনফারেন্সে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ রংপুর বিভাগের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান, টিপু মুন্সি, নুরুল ইসলাম সুজন, রমেশ চন্দ্র সেন, মোতাহার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও তথ্য সচিব মর্তুজা আহমেদ, শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসেইন, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী।
দেশের মাটিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে স্থান না দেয়ার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়েকদিন আগে আমাদের গাইবান্ধায় একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য যে জামায়াত-শিবিরের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো, মানুষকে সব সময় নিরাপত্তা দিতো, তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে, সংসদ সদস্যকে এভাবে হত্যা করা এটা কখনই মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি- যারা এর সঙ্গে জড়িত যে কোনোভাবে তাদেরকে (আততায়ীদের) খুঁজে বের করতে হবে। কারণ ঐ সুন্দরগঞ্জে আমরা জানি তারা কিভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল। কিভাবে তারা দোকানপাট, সরকারি অফিস-আদালত পুড়িয়েছিল। কিভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পুলিশকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তাদের অত্যাচার-নির্যাতনে ঐ এলাকার মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। এর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছিল এই লিটন। অথচ তাকেই তারা হত্যা করলো। কাজেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমরা কখনই মেনে নিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবেই বাংলার মাটিতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলবো যেভাবেই হোক অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং এদের উপযুক্ত শাস্ত্তি অবশ্যই দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত গাইবান্ধার পুলিশ সুপারের কাছে লিটন, গাইবান্ধায় পুলিশ হত্যাসহ বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর আসামি গ্রেপ্তার এবং তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের মামলা ও দ্রুত বিচার আইনে নিষ্পত্তি হয়ে অদ্যাবধি অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি দ্রুত এই সব মামলার চার্জশিট প্রদান এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে। এ দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমরা এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো। বাংলাদেশের অধিকতর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই।
প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জনগণ, জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ তলা ড. ওয়াজেদ আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও ১০ তলা শেখ হাসিনা মহিলা ডরমিটরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গণভবন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এ কে এম নূরুন্নবী রংপুর থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে আমাদের শিক্ষার্থী সমাজকে মুক্ত রাখার জন্য সচেষ্ট হওয়ার জন্য শিক্ষক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, শিক্ষক সমাজকে আমি একটা কথা বলবো- জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে আমাদের শিক্ষার্থী ও সমাজকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনোমতেই যেন এখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দানা বাঁধতে না পারে। কারণ রংপুর বিভাগে আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে যে তাণ্ডব হয়েছে- মানুষ হত্যা করা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, গাছপালা কেটে ফেলা। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট তারাই আবার জঙ্গির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। পুলিশ হত্যা করেছে। আর সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়।
তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নাই। আর কে ভালো কে মন্দ- সে বিচার করবেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এটা বিচারের দায়িত্ব মানুষকে আল্লাহ পাক দেন নাই। কাজেই মানুষকে খুন করে কোনো ভালো কাজ হতে পারে বা মানুষকে খুন করে কেউ বেহেস্তে যেতে পারে- সেটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ এভাবে কেউ যে বেহেস্তে গেছে তা কেউ জানতে পারেনি। কাজেই এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আমাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ব্যাপারে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্র্থী এমনকি কর্মচারী সকলকে আহ্বান জানাবো- সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, যেন আমরা বাংলাদেশটাকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী তার নামে ছাত্রী হলের নামকরণ প্রসঙ্গে বলেন, আসলে আমার নামে আমি কোনো কিছু করতে চাই না। কারণ আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি চাই- বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকুক। আমার প্রতিদিনের কাজ একটাই এদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করা। এদেশের মানুষ যেন একটু সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, একটি সুন্দর জীবন পেতে পারে- সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। যেটা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল। বাংলার মানুষ যেন অন্ন পায়, বস্ত্র পায়, শিক্ষা পায় এবং উন্নত জীবন পায়। এখানে আমি ব্যক্তিগতভাবে কি পেলাম না পেলাম সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম। আজকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই সুযোগটা মানুষ পাচ্ছে। তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ একটি আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মময় জীবন ও স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই ইন্টারন্যাশনাল রিসার্স ইনস্টিটিউট যে গড়ে তুলেছেন, সেটা একটি মানসম্পন্ন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে- সেটাই আমি আশা করি।
স্বাধীনতার পক্ষের বলেই জীবন দিতে হলো লিটনকে
ওদিকে গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভার আগে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লিটনের ওপর বারবার হামলা হয়েছে। মাঝে একটা ঘটনা ঘটার পর তার কাছ থেকে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র নিয়ে নেয়া হয়। তারপর থেকে সে আতঙ্কে থাকতো সবসময়, কখন তার ওপর হামলা হয়। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো, তাকে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর নামে তারা আন্দোলন ডেকে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। সেসময় তিনি (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া) ঘোষণা দেন, তিনি নাকি সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। লোকজন লেলিয়ে দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেন। সারাদেশে তাণ্ডব শুরু হয়। আন্দোলনের নামে সারাদেশেই এভাবে আগুনে মানুষ পোড়ানো হয়। আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। নির্বাচনের দিন প্রিজাইডিং অফিসার হত্যা করেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দিয়েছে, প্রকৌশলী হত্যা করেছে। তিনি লিটন হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, ওই আন্দোলনের মধ্যে জামায়াত অনেক নাশকতা করতে চেয়েছিল। লিটন তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে একাত্ম করেছিল। সেজন্য তার ওপর জামায়াতের ক্ষোভ ছিল। মাঝে একটা ঘটনা ঘটলো। একটা শিশুর গায়ে গুলি লাগলো। সেটাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে এমনভাবে লেখা হলো, আসলে কী ঘটলো, সেটা কেউ লিখলো না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, লিটনকে মারতে গিয়েছিল একদল, সেসময় সে আত্মরক্ষা করতে চাইলে ওই শিশুর গায়ে গুলি লাগে। কিন্তু তারপর তার নামে মামলা হয়, ওর কাছ থেকে লাইসেন্স করা অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে সে আতঙ্কে ছিল আবার কখন তার ওপর হামলা হয়, ঠিকই তার ওপর হামলা হলো, তাকে হত্যা করা হলো। সে (লিটন) স্বাধীনতার পক্ষের বলেই জীবন দিতে হলো। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বলেই এমনটা হলো। প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমি জানি না, ওদের আর কী লক্ষ্য আছে, খুন করাই তাদের চরিত্র। এরাই তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। খুনি অপরাধীর সাথী খালেদা জিয়া। তিনি অন্যায় করেনও, অন্যায় প্রশ্রয়ও দেন। এসময় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালেও সে দলের অনেক এমপি-নেতাকে হত্যার চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। উল্লেখ করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, গাজীপুরের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড হামলার কথাও। এমপি লিটন হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি আবারও বলেন, হত্যাকাণ্ডটি কখনোই মেনে নিতে পারি না। রংপুর বিভাগের ৫ জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে একটাই কথা বলেছি- জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে। সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | ||
6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 |
13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 |
20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 |
27 | 28 | 29 | 30 | 31 |