দিনভর উৎসবমুখর পরিবেশ।ব্যতিক্রমী এক ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেরও তেমন কোনো অভিযোগ নেই। নেই বিশৃঙ্খলা, দখল কিংবা বর্জন। ভোটের আগে নানা শঙ্কা আর অভিযোগ অনুযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ব্যতিক্রমী এক নির্বাচনই হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ৭৯,৫৬৭ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করেছেন। আর এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করেেপারেশনে দ্বিতীয়বারের মত মেয়র নির্বাচিত হলেন আইভী। রাতে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে রিটার্নিং অফিসার ১৭৪টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন। এতে নৌকা প্রতীকে সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট।
নির্বাচনকে ঘিরে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা চাইলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় তা প্রমাণ হয়েছে। সবার সহযোগিতায় ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে জানিয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সিইসি।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। তারা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু করার ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনে প্রায় ৬৪ ভাগ ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশন আগামী ২৪শে ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকায় মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। ভোটারদের নিরাপত্তায় এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা। ২২ প্লাটুন বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৯ হাজার সদস্যের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে রাতে জয়ের খবর পেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই হবে সমাপ্ত করাই হবে তার লক্ষ্য, তার এ বিজয়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেন। অন্যদিকে সাখাওয়াত হোসেন খান রাতে ‘নির্বাচনে সুক্ষ কারচুপির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না’ বলে মন্তব্য করেন। এদিকে আইভীর বিজয়ে রাতেই নারায়ণগঞ্জজুড়ে আইভী সমর্থকরা উল্লাস প্রকাশ করেন।
অভিযোগ ছিল না দুই প্রার্থীর
এর আগে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যেই নিজেদের ভোট দেয়া শেষ করেন দুই হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান। এসময় তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক। এদিকে নিজেদের ভোট দেয়ার পর থেকে এ দুই প্রার্থী ছুটেছেন এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে। ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত ছিল। কর্মীদের কাছে কোনো কেন্দ্র নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছেন সেখানে। নিজে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, কথা বলেন কেন্দ্রে আসা উপস্থিত ভোটার ও দায়িত্বরত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। নিজেদের ভোট দেয়ার পরই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। এসময় দুজনই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়ার প্রত্যয়ের কথা জানান। একইসঙ্গে সন্তোষ প্রকাশ করেন নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। এসময় দুজনই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের আশা প্রকাশ করেন। ওদিকে ভোটের প্রথম প্রহরে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মইনুল হক। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জবাসী ইতিহাস তৈরি করবে বলে মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একই ভূমিকা পালন করবে বলে ঘোষণা দেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ফল মেনে নেবো: সাখাওয়াত
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে ভোট দেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান। সকাল ৮টায় সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ডের আদর্শ স্কুল কেন্দ্রে যান সাখাওয়াত হোসেন খান। সেখানে ৮টা ০৫ মিনিটে ভোট দেন তিনি। এসময় ওই কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম দেখা যায়। কেন্দ্র থেকে বের হয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান সাখাওয়াত। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ভেতরের পরিবেশ ভালো। আশা করছি শেষ অবধি এই পরিবেশ বজায় থাকবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত ভোট অনুষ্ঠান করবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই প্রথম প্রহরে এসে ভোট দিলাম। ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই অভিযোগ করে সাখাওয়াত বলেন, বিজিবি মোতায়েনের কথা শুনেছি। কিন্তু কোনো কেন্দ্রে বিজিবি সদস্য দেখিনি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কেন্দ্র থেকে অনিয়মের খবর পাননি উল্লেখ করে সাখাওয়াত বলেন, এ পর্যন্ত কোনো খারাপ খবর পাইনি। আশা করছি, শেষ পর্যন্ত এমন খবর পাবো না। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ভোটের ফল যাই হোক না কেন মেনে নেব। তবে প্রশাসন যেন কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য না করে। সাখাওয়াতের পাশে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, এখন পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা গেছে। আশা করি, শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশ থাকবে। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলে দায়ী থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। আশা করছি তিনি এই নির্বাচন সুষ্ঠু করার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথ সুগম করবেন। এদিকে নিজের ভোট দিয়েই সাখাওয়াত ছুটে যান এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে। সকাল ৮টায় ভোট দেয়ার সাড়ে চার ঘণ্টা পর ১০ নং শীতলক্ষ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাখাওয়াত হোসেন খান মানবজমিনকে বলেন, সকালে পরিবেশ যেমন দেখেছি এখন পর্যন্ত সেরকমই আছে। সবকিছু ঠিক আছে। বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শুনিনি।
জনতার রায় মানতে প্রস্তুত সবসময়: আইভী
নির্বাচনী লড়াইয়ে ভোটাররা যাকেই ভোট দিক না কেন, তা মানতে সব সময় প্রস্তুত বলে জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বলেন, সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। জনতার রায় সবসময় মেনে এসেছি। সকাল সাড়ে ৯টায় নারায়ণগঞ্জের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের শিশুবাগ স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে এ প্রতিক্রিয়া জানান আইভী। আইভীর নিজ এলাকায় অবস্থিত ওই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তার পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা। ওই কেন্দ্রে সকাল থেকে বিপুল পরিমাণ ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইভী বলেন, সকাল থেকে অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে ভোট হয়েছে। আশা করি বিকাল পর্যন্ত এই সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে নৌকার বিজয় হবে, জনতার বিজয় হবে। শামীম ওসমান শেষ পর্যন্ত মাঠে আছেন কিনাÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঠে সবাই নেমেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত এই মেয়র প্রার্থী বলেন, সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জের বিষয়ে আপনারা যাই বলুন না কেন নির্বাচনের সময় নারায়ণগঞ্জে সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকে। আজও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হচ্ছে। জনতার রায় আমি মানতে প্রস্তুত। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইভী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে তৎপর রয়েছে, আপনারা যাই বলুন না কেন কোনো অঘটন ঘটবে না। নিজের ভোট দেয়া শেষে আইভী ছুটে বেড়ান এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে। এসময় ভোটারদের খোঁজখবর নেন। পাশাপাশি কথা বলেন নির্বাচনী কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে।
শান্তিপূর্ণ ভোটে খুশি ভোটার
ভোট খুব ভালো হচ্ছে। এমন সুষ্ঠু ভোট কখনো দেখিনি। শান্তিতেই ভোট দিতে পারলাম। নিজের ভোট নিজে দিয়েছি। তবে অনেক সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কথাগুলো বললেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা কুলসুম বিবি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও লাঠিতে ভর করে সিদ্ধিরগঞ্জ দক্ষিণ প্রাথমিক বিদ্যালয় (কলাবাগ পূর্ব) মহিলা ভোটকেন্দ্রে আসেন বেলা ১০টার দিকে। ১১টার দিকে ভোট দিতে পারেন তিনি। কিন্তু ভোট দেয়ার পর তার ভোটার আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ হয় তার। ৬নং ওয়ার্ডে অ্যাকটিভ হাইস্কুলে ভোট দিয়ে নিলুফার ইয়াসমিন জানান, পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকলেও ভোটগ্রহণ ছিল ধীরগতি। ফলে অনেক মহিলা ভোটার বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে গেছেন। তবে কেন্দ্রের ভেতর মহিলা ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের ১০টি ওয়ার্ডে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। সকালের দিকে মহিলা ভোটারের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ে তাদের উপস্থিতি। কেন্দ্রের ভেতর সুশৃঙ্খল পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। বাইরেও ছিল আনন্দঘন পরিবেশ। সকাল ৯টায় ৬নং ওয়ার্ডের সফর আলী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ৬নং বুথের (পুরুষ) সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তহুরুন নেছা জানান, তার বুথে প্রথম ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ২৫টি। ৯টা ৪০ মিনিটে ৪নং ওয়ার্ডের ডিএনডি প্রকল্প প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৩, ৪ ও ৮নং বুথে (পুরুষ) ধানের শীষের এজেট পাওয়া যায়নি। এসব বুথের সহকারী প্রিজাইডং অফিসার মিজানুর রহমান, রইজ উদ্দিন বিশ^াস ও আরিফা ইয়াসমিন এজেন্ট না থাকার কথা স্বীকার করেন। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ১নং বুথেও (মহিলা) ধানের শীষের এজেন্ট ছিল না বলে জানান ওই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আবদুল হান্নান মিয়া। বেলা সাড়ে ১১টায় ৫নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৩নং বুথে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টায় ভোট কাস্ট হয় ৬৬টি। ওই বুথে মোট ভোটার ৩৫৯। ওই কেন্দ্রের ১নং বুথে নৌকার এজেন্ট পাওয়া যায়নি। দুপুর ১২টার দিকে ১নং ওয়ার্ডে মিজমিজি পাইনাদী রেকমত আলী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ৩নং বুথে (পুরুষ) নৌকার এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ৬নং বুথে ২৫৯ ভোটারের মধ্যে ১২০ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে জানান সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার সাইদুর রহমান। বেলা পৌনে ১টার দিকে ৭নং ওয়ার্ডের আদমজী এমডব্লিউ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের দেখা যায় শত শত উৎসুক মানুষের ভিড়। উৎসুবমুখর এক পরিবেশ বিরাজ করে সেখানে। মহিলা কেন্দ্রের ৮নং বুথে গিয়ে দেখা যায় ৩৮৫ ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৮৬ ভোট। ওই বুথের প্রিজাইডিং অফিসার নাদিম হোসেন জানান, সকালের দিকে ভোটার উপস্থিতি থাকলেও দুপুরে তা হ্রাস পায়। ওই বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মির্জা আলী ওসমান জানান, তার কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৭৩০। দুপুর ১টা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ ভোট কাস্ট হয়েছে। বেলা দেড়টায় ৬নং ওয়ার্ডের সুমিলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ১নং বুথে (পুরুষ) ধানের শীষ ও ২নং বুথে নৌকার এজেন্ট নেই। ওই দুই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জয়নাল আবেদীন ও রতন চন্দ্র কর জানান, সকালে তারা আসেনি। ৬নং বুথে (মহিলা) নৌকার এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ওই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার শিল্পী রানী ধর জানান, তার বুথে ৩৯৬ ভোটের মধ্যে ২৩৫ কাস্ট হয়েছে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার কামিরুল ইসলাম জানান, তার কেন্দ্রে মোট ২ হাজার ২৯০ জন। বেলা ১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫০ ভোট কাস্ট হয়েছে। বেলা ২টায় সফুরা খাতুন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে পুরুষ কেন্দ্রের ৪নং বুথে ধানের শীষের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এনামুল হক জানান, তার বুথে ৩২১ ভোটের মধ্যে ১৮৮ ভোট কাস্ট হয়েছে বেলা ২টা পর্যন্ত। এর আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে বিশৃঙ্খলার খবর পেয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুর রহমান নুরুজ্জামান কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পর কেন্দ্রে আসেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, গ-গোলের খবর শুনে এসেছি। তাছাড়া কোথাও কোথাও আমাদের ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, আমার কাছে খবর আছে। নির্বাচন কেমন হচ্ছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে এখন কথা বলবো না। এখন কাজ করার সময়। পরে আবার তিনি বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হচ্ছে কিনা তা জনগণ বলবেন। বেলা ২টা ১০ মিনিটে ৮নং ওয়ার্ডের পপুলার হাইস্কুলে গিয়ে দেখা যায় এক প্যান্ডেলের ভেতর সারিবদ্ধ ৯টি বুথ। ভোটার উপস্থিতি প্রতিটি বুথে ২/৩ জন। ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মো. ওয়ালী উল্লাহ জানান, তার বুথে ৩৬০ ভোটের মধ্যে ২১৮ ভোট কাস্ট হয়েছে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। ওই স্কুলের মহিলা কেন্দ্রের ২নং ও ৮নং বুথে নৌকার এজেন্ট পাওয়া যায়নি। মহিলা কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. মোস্তফা জানান, তার কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৮৭৯ জন। বেলা ২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ১ হাজার ৪১২ ভোট কাস্ট হয়েছে। তাঁতখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় পুরুষের চেয়ে মহিলা ভোটারের উপস্থিতি বেশি। কেন্দ্রের বাইরে উৎসুক মানুষের ভিড়।
এদিকে ভোটারদের উপস্থিত কম লক্ষ্য করে তাদের কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের সফুরা খাতুন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইভী এ আহ্বান জানান। সাংবাদিকের এক প্রশ্নে সাবেক এই মেয়র বলেন, এখন পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি একটু কম বলেই মনে হচ্ছে। ভোটাররা হয়তো কাজকর্ম সেরে কেন্দ্রে আসার কথা ভাবছেন।
ভোটারদের উদ্দেশ্য আইভী বলেন, ‘আমি বলবো, আপনারা বেরিয়ে আসুন। ভোট দিন। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হচ্ছে।’ এর আগে সকালে দেওভোগ শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন আইভী। এরপর কেন্দ্র পরিদর্শনে বের হন। সিদ্ধিরগঞ্জের পথে বিভিন্ন জায়গায় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে উৎসাহী করার জন্য কর্মী-সমর্থকদের নির্দেশ দেন আইভী।
অভিযোগ ছাড়াই দিন পার
নারায়ণগঞ্জে এক অন্যরকম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ব্যতিক্রম। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ। হয়নি হানাহানি। ছিল না অস্ত্রের ঝনঝনানি। নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিনের নানা শঙ্কাও দূর হলো। নারায়গঞ্জবাসী দীর্ঘ দিনের বদনাম ঘুচালো। তবে কিছু বিচ্ছিন্ন অনিয়ম ছিল। গতকাল দ্বিতীয় নাসিক নির্বাচনের বিভিন্ন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণে এসব চিত্র চোখে পড়ে।
সকাল ৭টা ৪০ মিনিট। ১২ নম্বর ওয়ার্ড। ডন চেম্বার রোড। ফিলোসোফিয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ভোট কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় ৫নং পুরুষ ভোটকক্ষ। ওই কক্ষে ঢুকে দেখা যায় ভোট গ্রহণের জন্য চলছে প্রস্তুতি। তবে সেই ভোট কক্ষে কেউ নেই। ব্যালট বাক্স ও ব্যালট রাখা আছে একটি টেবিলের ওপর। তা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার চোখে পড়ে। তিনি ডাকাডাকি করেন। পরে উপস্থিত হন দায়িত্বরত সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আবু তালেব। এরপর সেখানে শাহজাহানসহ অপর এক নারী পোলিং অফিসারকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেখা যায়।
ওই ভোট কক্ষে ব্যালট ও বাক্স অরক্ষিত কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অরক্ষিত হবে কেন? আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রস্তুতি সম্পন্ন করার শেষ সময় ৭টায় কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। পোলিং অফিসার শাহজাহান বলেন, আমার দায়িত্ব এই বুথে পড়েছে। এখন এসেছি। ওই বুথে প্রথম ভোট দেন ব্যবসায়ী জাহিদ আহমেদ। তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি ভোট দিতেই সকাল সকাল চলে আসি। প্রায় আধঘণ্টা ধরে লাইনে আছি। সকাল ৮টার পরপরই কেন্দ্রের বাইরে লাইনে দাঁড়নো ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকানো হয়। একই ভোট কেন্দ্রের ১ নম্বর কক্ষে ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান খান, ৪ নম্বর কক্ষে চাকরিজীবী বাবুল হোসেন এবং ১০ নম্বর কক্ষে গৃহিণী শামিমা সুলতানা প্রথম ভোট দিতে দেখা গেছে। দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ১৩৫ নম্বর কেন্দ্রের ১ নম্বর ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় প্রায় একঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজমা। লাইনের সিরিয়াল অনুযায়ী ভোটারের পরিচয় শনাক্তকারী পোলিং অফিসার শোয়েব মনিরের কাছে যান তিনি। মনির তার নাম ও ছবি মিলিয়ে দেখেই বলেন, ‘আপনি ঠিকই আছেন। তবে আপনি আসার আগেই কেউ আপনার ভোট দিয়ে চলে গেছে।’ থ বনে যান নাজমা। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। বলেন, ‘তাহলে আমি ঘরে দু’বাচ্চাকে উপোস রেখে এসে একঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলাম কেন?’ তখন একাধিক পোলিং এজেন্টও এজন্য প্রতিবাদ জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার ভোটার নম্বর ৬৭১৫৮৭০০০০৩৪। তার বাড়িও বন্দর থানার ফরাজীকান্দায়। স্বামীর নাম মো. কাজী মাসুদ। এ বিষয়ে জানতে চাইল ওই ভোট কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার রওশন জামাল বলেন, তা কীভাবে হলো শনাক্তকারী পোলিং অফিসার বলতে পারবেন। পোলিং অফিসার শোয়েব মনির বলেন, এটা কীভাবে হলো তা বুঝতে পারছি না। আমার ভুলও হতে পারে। ওই কেন্দ্রের দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার বাবু লাল বৈদ্য মানবজমিনকে বলেন, প্রার্থীর প্রতিনিধিরা তা ধরতে না পারলে আমরা কি করতে পারি।
সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট। বন্দর থানাধীন ২২ নম্বর ওয়ার্ড। বন্দর গালর্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ৬ নম্বর ভোটকক্ষ। বসে আছেন প্রার্থীর প্রতিনিধিরা। নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে তাদের প্রায় সবাই ধারণ করেছেন নিজ নিজ প্রার্থীর ছবি ও প্রতীক সম্বলিত ব্যাচ। একইচিত্র পাশের ৫ নম্বর বুথেও। ওই কক্ষের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জীবন চন্দ্র দাশ বলেন, বুথে তা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তবে বুকে লাগানো প্রার্থীর ব্যাচ খুলে ফেলতে বলা হয়নি। প্রিজাইডিং অফিসার স্যার বললে আমি তা খুলে ফেলার জন্য বলবো। এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. সবুর খান বলেন। আমি বুথে গেলে পোলিং অফিসাররা তা খুলে ফেলে। আবার আমি চলে আসলে তারা ঝুলান।
তবে পাশের অপর একটি ১৪৮ নম্বর কেন্দ্র বন্দর শিশুবাগ বিদ্যালয়ে ভিন্ন চিত্র। সেখানে সকাল ৮টার মধ্যে প্রার্থীর প্রতিনিধিরা কেন্দ্রে পৌঁছান। নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব প্রিজাইডিং অফিসার হেদায়েত উল্লাহ চৌধুরী তাদেরকে নির্বাচন কমিশন থেকে প্রদান করার জন্য দেয়া পোলিং এজেন্টের নির্ধারিত পরিচয় পত্রই বিতরণ করেননি। নিজের কাছে রেখে দেন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পোলিং এজেন্টরা সকাল ৮টার দিকে কেন্দ্রে আসায় তা দেয়া হয়নি। এর প্রতিবাদ জানিয়ে ২ নম্বর বুথের এজেন্টরা তার সামনেই বলেন, আমরা সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কেন্দ্রে এসেছি। ফলে একই কেন্দ্রের কোনো বুথে ওই সময় পর্যন্ত এজেন্ট পরিচয় পত্র পাননি।
সকাল ৮টা ৩৮ মিনিট। বন্দর থানাধীন ২২ নম্বর ওয়ার্ড। ১৪৭ নম্বর বন্দর শিশু নিকেতন কেন্দ্র। ২ নম্বর কক্ষ। ওই ওয়ার্ডে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর আসনে ৪ জন প্রার্থী থাকলেও ওই সময় পর্যন্ত কোনো পোলিং এজেন্ট উপস্থিত হননি। মেয়র পদে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে ২ জন পোলিং এজেন্ট উপস্থিত থাকলেও বাকি ৫ প্রার্থীর কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিল পদের ৫ প্রার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তিনজন। শুধু ওই কেন্দ্র নয়। অধিকাংশ বুথেই প্রায় অর্ধেক পোলিং এজেন্ট অনুপস্থিত ছিল। বন্দর থানা এলাকার আরো অন্তত অর্ধশত বুথে একই চিত্র চোখে পড়েছে।
এ ছাড়া সোনাকান্দা বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ১০টার দিকে বন্দর থানার আওয়ামী লীগ নেতা আবেদ হোসেন নৌকা প্রতীকের ব্যাচ ধারণ করে কেন্দ্রে ঢুকতে গেলে বাধা দেয় পুলিশ। এতে পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হয়। পরে বিজিবির স্ট্রাইকিং ফোর্স ও র্যাবের মোবাইল টিম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ছাড়া আরো অন্তত অর্ধডজন স্থানে ছোটখাটো উত্তেজনা পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানা এলাকার ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ শফিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেছেন, টুকিটাকি কিছু বিচ্ছিন্ন অনিয়ম হয়েছে। সকালের দিকে কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিনিধি পোলিং এজেন্টরা প্রার্থীর প্রতীক নিয়ে কেন্দ্রে অবস্থান করেছিল সেটা ঠিক। পরে বিভিন্ন কেন্দ্র পরিবদর্শনের সময় তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আর একজনের ভোট আর একজন দিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আমার এলাকায় বলে শুনছি। এ বিষয়ে জানার জন্য নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. নুরুজ্জামান তালুকদারের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |