চট্টগ্রামবাসী বিজয়ের ৪৬ বছরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখেছে। বিগত বছরগুলোতে চট্টগ্রামবাসী আরও ৪৫টি বিজয় উৎসব দেখলেও এবারেরটি ছিল ব্যতিক্রম। দিবসের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের এমন ঢল যেমন আগে কখনও দেখেনি তেমনি দেখেনি জয় বাংলা মিছিলের প্রকম্পন।

মোড়ে মোড়ে দেখেছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিশু-কিশোরদের চিন্ত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার উচ্ছ্বাস। দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানীদের বীরোচিত সংবর্ধনা। দেখেছে সরকারি-বেসরকারি ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশ ও সেমিনার।

শুক্রবার রাত ১২ টা ১ মিনিটে নগর পুলিশের একটা চৌকস দল সশস্ত্র অভিবাদনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। ফুলে ফুলে ভরে যায় শহীদ মিনার। ফুলের তোরণে ঢাকা পড়া শহীদ মিনার উম্মুক্ত করতে হিমশিম খেয়ে যায় অনেকে।

শুরুতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তার পরে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যান ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এরপর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নিয়ে করপোরেশনের পক্ষে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। একই সাথে নগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীরা সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরে নেতৃতে ফুল দেন।

পরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, বিভাগীয় কমিশনার মো.রহুল আমিন, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সামশুল আরেফিন, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার ও চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এরপর জেলা কমান্ডার মো. সাহাবউদ্দিন ও মহানগর ইউনিটের কমান্ডার মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পৃথকভাবে শহীদ মিনারে ফুল দেন। শহীদ বেদিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করান। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শত শত তরুণও শপথ নেন।

শপথবাক্যে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, একাত্তরে যেভাবে শেখ মুজিবের ডাকে তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এখন শেখ হাসিনার ডাকেও তারা যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত-মৌলবাদমুক্ত দেশ গড়ার জন্য যেকোনো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

তারা তরুণদেরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক-মৌলবাদমুক্ত দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। শপথ পাঠ শেষে জয় বাংলা শ্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে।

এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম বক্করের নেতৃত্বে বিএনপি যুবদল ছাত্রদলের উদ্যোগে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন দলের নেতাকর্মীরা।

রাত থেকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীতে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। বিজয় দিবসের রাতে ১০টার পর শহীদ মিনার এলাকায় আড়াই শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। হ্যান্ডমেটাল ডিটেক্টর দিয়ে যারা শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেছে তাদের চেক করা হয়।

সকাল সাড়ে ১০টায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের আয়োজনে নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের গোলচত্বর থেকে বের হয় ‘জয় বাংলা’ বিজয় র‌্যালি। র‌্যালিতে নেতৃত্ব দেন বিজয় মেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি একটি মিনি ট্রাকে বসে রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষমাণ নগরবাসীকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।

র‌্যালিতে বিজিবি, কোস্টগার্ড, নগর পুলিশ (সিএমপি), র‌্যাব, জেলা পুলিশ, রেল পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ভিডিপি, মেরিন একাডেমি, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো।

র‌্যালির অগ্রভাগে ছিল শতাধিক মোটরসাইকেল। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জাতীয় চার নেতার বিশাল বিশাল প্রতিকৃতি। ছিল দুটি ঘোড়ার গাড়ি আর বেশ কিছু বাদকদল।

র‌্যালিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থার হাজারো নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে অংশ নেন। তাদের জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয় চট্টলার রাজপথ। মিছিলটি কাজীর দেউড়ি, এসএস খালেদ রোড, জামালখানসহ নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

দুপুরে নগরীর সার্কিট হাউজে ১৪১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সংবর্ধনার অংশ হিসেবে তাদের হাতে ফুল, ক্রেস্ট, উত্তরীয় তুলে দেয়া হয়। ১৪১ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৯৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত। বাকি ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম নগর কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমিন।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ, মো. শফিকুল ইসলাম, নগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার, জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন, পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ডার মো. সাহাবউদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমদ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ডের উদ্যোগে বের করা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমুলক বই ‘মুক্তি’র মোড়ক উম্মোচন করা হয়। পরে সব মুক্তিযোদ্ধাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমিন বলেন, বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার পরে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে পরাধীনতার সেই সময়গুলোতে ফিরিয়ে নেয়ার। কিন্তু বাঙালি ষড়যন্ত্রের দিকে কখনও ফিরে যাবে না। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেকোনো কাজে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে জানান।

ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ, মো. শফিকুল ইসলাম নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। আমি গ্রামেই এসএসসি পাস করেছি। সেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তান আমি আজ ডিআইজি হয়েছি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমি এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। কারণ পাকিস্তানিরা আমাদের সন্তানদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কখনও বড় জায়গায় যেতে দেয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কমান্ডার মো. সাহাবউদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন, কিছু পাওয়ার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাইনি, গিয়েছি দেশের জন্য জীবন দিতে। তাই আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধারা এখনও বেঁচে আছি তাদের কাছে এটি বাড়তি জীবন।

তিনি বলেন, আমরা দুই লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আজ আমরা ১৬ কোটি মানুষ। আমরা দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা এই ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাবো।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফয়েস লেক বধ্যভূমিতে দেখলাম রান্নার আয়োজন হচ্ছে, জুতো নিয়ে বধ্যভূমির উপর হাঁটাচলা করছে মানুষ। এই ধরনের আচরণ কেমনে করে। চট্টগ্রামে যেসব বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে-এটাই আমাদের দাবি।

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন মুক্তিযোদ্ধাদের সবসময় সহায়তা করা এবং ভবিষ্যতেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রদান অব্যাহত রাখা হবে বলে জানান।

এছাড়া নগরীর প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি কিন্ডার গার্টেনস্কুলোতেও দিনভর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা-সেমিনারের আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাবলীর ওপর। নগরীর ৪১ ওয়ার্ডেও একাধিক স্থানে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন, শেখ রাসেল ক্রীড়া পরিষদগুলোও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

এরমধ্যে নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় শিশু-কিশোরদের নিয়ে চিন্ত্রাঙ্কন ও কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে শেখ রাসেল স্মৃতি পরিষদ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এম ওয়াহিদ এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সব বীর সেনানীর আত্মার মাগফেরাতে রাতেই মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে বলে জানিয়েছেন ওয়াহিদ।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031