দুই আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্বদানকারী আলবদর বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মূলত হত্যার পরিকল্পনা ও বাহিনীর নেতা হিসেবে সব দায় নিয়ে দণ্ড পেয়েছে এই দুই জামায়াত নেতা। তবে মাঠ পর্যায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যায় যাদেরকে মূল খলনায়ক চিহ্নিত করা হয়েছে  ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংস্থার এই দুই নেতার বিরুদ্ধে রায় হয়েছে তিন বছর আগে। কিন্তু এখনো তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে পারেনি সরকার। এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও নেই।

২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর এ দুই ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পলাতক মুঈনুদ্দীন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আর আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। নয় মাস যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ ব্যক্তি হিসেবে আলবদর বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’।

এই দুই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করতে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে। মন্ত্রী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানসহ ২২ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এদের মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশে আছে।

সানাউল হক বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এসব আসামিকে ফিরিয়ে আনার কার্যকর তেমন উদ্যোগ দেখছি না’। এই দুই দণ্ডপ্রাপ্তকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তদন্ত সংস্থার এ কর্মকর্তা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যাসহ ১১টি অভিযোগই বুদ্ধিজীবী হত্যার মূলহোতা মুঈনুদ্দীন ও আশরাফু্জ্জামানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়। সবগুলো অভিযোগেই একমাত্র সাজা মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আদালত রায়ে বলে, দুই আসামির আত্মসমর্পণ অথবা গ্রেপ্তারের পর এই সাজার রায় কার্যকর করা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাজা পরোয়ানার একটি কপি পুলিশ মহাপরিদর্শক ও একটি কপি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।

বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক তারাই

১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন কীভাবে আলবদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন, তা উঠে এসেছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে এই হত্যা পরিকল্পনা ও টার্গেট ব্যক্তিদের একটি তালিকাও পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মামলার এই রায় দেয় আদালত।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তবে ওই হত্যার মূল খলনায়ক ছিলেন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। এই নৃশংস অপরাধের জন্য তারা ‘শুধু এবং শুধুমাত্র’ ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।

রায়ের অভিমতে বলা হয়, এটা প্রমাণিত যে বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল ফ্যাসিস্ট জামায়াতের সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে আলবদর বাহিনীকে নিয়োগ দেয়া হয় এদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে। আলবদর বাহিনী জামায়াতের নীলনকশা সম্পন্ন করতে ‘কিলিং স্কোয়াড’ হিসেবে কাজ করে।

জিয়া ও এরশাদের আমলে সম্মানিত হন দুই বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, ফেনী জেলার পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন অনুযায়ী জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন পাকিস্তানি দূতাবাসের গাড়িতে করে নিজ গ্রামে গেছেন। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর, তাদের (জিয়াউর রহমান ও এরশাদের) শাসনামলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যে মুক্তিযুদ্ধের পরে লুকিয়ে ছিল এবং পরে পালিয়ে যায় তাকে রাষ্ট্রীয় পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে তার নিজ গ্রামে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে তিরস্কার করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়েছে। এটা লজ্জার, শুধুই লজ্জার। এটা জাতিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

কোথায় আছেন মুঈনুদ্দীন

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের জন্ম ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে, ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতে তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দাওয়াতের বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুঈনুদ্দীন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন পরিচালক, মুসলিম এইডের ট্রাস্টি এবং টটেনহ্যাম মসজিদ পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। একাত্তরে ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতার’ পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে স্বীকারও করেছেন তিনি।

আরেক খুনি আশরাফুজ্জামানের অবস্থান

আরেক বুদ্ধিজীবী হন্তারক আশরাফুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪৮ সালে, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান।

মক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা আলবদর বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব আশরাফুজ্জামানের ওপর বর্তায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং বাস্তবায়নকারী নেতা হিসেবেও তাকে অভিযুক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আশরাফুজ্জামান ছিলেন আলবদর বাহিনীর গাজী সালাউদ্দিন কোম্পানির কমান্ডার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। পরে সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে আশরাফুজ্জামান খানের ঠিকানা নিউইয়র্কের জ্যামাইকা। ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদরের দুই শীর্ষ নেতার ফাঁসি

বুদ্ধিজীবী হত্যার রায়ে ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয় চলতি বছরের ১১ মে। বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাবনার দুটি এলাকায় ৫০২ জনকে হত্যার দায়ে এই সাজা পেয়েছেন তিনি।

আর মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। তিনিও বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031