সুরক্ষা পদ্ধতিকে ধাপে ধাপে অরক্ষিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জেনেশুনেই বা বুঝেই রিজার্ভ । আর এর সুযোগ নিয়েছে হ্যাকারচক্র। এই কাজের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘যখন কোনও ঘটনা ঘটে আমরা সেখানে থাকা মানুষগুলোকে প্রথমে ভিকটিম হিসেবেই দেখি। তাদের সন্দেহ করি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়েও তাই ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ যেভাবে রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত সুরক্ষিত। এটাকে জেনেশুনে বা বুঝেই অরক্ষিত করা হয়েছে। হ্যাকাররা এখানে তিনটি ধাপে কাজ করেছে। প্রথমত, রিজার্ভ সুরক্ষার পদ্ধতিকে ধাপে ধাপে অরক্ষিত করা হয়েছে। সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাই এই কাজটি করেছেন। প্রধান কম্পিউটারটিতে ইন্টারনেট ছিল না, সেটাতে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, হ্যাকাররা সিস্টেম অরক্ষিত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই অর্থ সরানোর কাজে নেমে পড়ে। তৃতীয়ত, টাকা বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের দুর্বল ব্যাংকিং পদ্ধতি যারা করে, সেসব ব্যাংককেই বেছে নিয়েছে হ্যাকাররা।’
শাহ আলম বলেন, ‘অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে কাজটি করা হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিকচক্র জড়িত। আমরা কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছি। তবে এই মুহূর্তে তাদের নাম বলতে চাই না। তাদের নাম বলা ঠিক হবে না।’
প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সরানোর চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে চারটি মেসেজের মাধ্যমে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকে (আরসিবিসি) সরিয়ে নেওয়া হয় ৮১ মিলিয়ন ডলার। আর একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। ওই সময় আরসিবিসি ব্যাংকে যাওয়া টাকার একটি বড় অংশ ফিলিপাইনের জুয়ার টেবিলে চলে যায়। এর মধ্যে এক ক্যাসিনো মালিক দেড় কোটি ডলার ফিলিপাইন সরকারকে ফেরত দেন। এই ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির বিষয়টি ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কান পুলিশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইও তদন্ত করছে।
এদিকে গত ২৬ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওই প্রতিনিধি দল ফিলিপাইন সফর করে। এ সফরের সময় বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম সেদেশের শীর্ষ আইন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে সহায়তা চেয়েছেন। সফর শেষে আইনমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে অগ্রগতি জানান তিনি। তখন সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘১৫ মিলিয়ন ডলার আমরা আগেই পেয়েছি। ২৯ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফ্রিজ করা আছে। সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় পেলেই আমরা এই ২৯ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাবো। এটি পেতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা ফিলিপাইন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী সেদিন বলেন, ‘বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমেই ক্যাসিনোতে গেছে। কাজেই এই টাকা রিজাল ব্যাংক কিভাবে দাবি করে সেটা আমার বোধগম্য নয়। রিজার্ভের চুরি যাওয়া টাকা আমাদের। আমরা অবশ্যই টাকা ফেরত পাবো।’
বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে ফিলিপাইন সরকার দুটি মামলা করেছে। আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখবো। আমাদের এখন করণীয় হচ্ছে, সেদেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।’