রাজধানীর পাশে অন্য এক জগৎ। রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি। অবৈধ ব্যবসার বদৌলতে অনেকে হয়েছে কোটিপতি। গড়ে উঠেছে ইয়াবা তৈরির কারখানা। রয়েছে মাদকের জাল। এছাড়া মুক্তা ব্যবসা, সাপের বিষের ব্যবসা, খয়ের পার্টি, মলম পার্টি, ছিনতাইকারী গ্রুপ থেকে শুরু করে কি নেই এখানে। গা-শিউরে উঠার মতো কাহিনী রয়েছে চনপাড়ায়। সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়ে নারী পাচারের ঘটনাও ঘটছে চনপাড়ায়। মানবজমিনের অনুসন্ধানে মিলেছে এমনই সব আশ্চর্য চমকপ্রদ তথ্য।
সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়ে সুন্দরী মেয়েদের পাচার: প্রতিবছর চনপাড়া পুনর্বাসন এলাকা থেকে ২০-২৫ জন সুন্দরী মেয়েকে সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়ে তিন থেকে ছয় মাসের ভিসায় ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি, বাহরাইন, কাতার, দুবাই, আরব-আমিরাত ও আফ্রিকায় পাঠানো হয়। এতে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। সুন্দরী মেয়েদের ভালো কাজের কথা বলে পাঠানো হয়। সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়ে সুন্দরী মেয়েদের পাচারের হোতা ২নং ওয়ার্ডের মনোয়ারা ওরফে (মনরি) ৬নং ওয়ার্ডের আলী হোসেন, ৩নং ওয়ার্ডের মমিন ও মিলন, ২নং ওয়ার্ডের সাদ্দাম ও শিউলী, ৮নং ওয়ার্ডের মোকলেস আর বহরের ফয়সাল। আর এদের মূল এজেন্সি নোয়াপাড়া এলাকার। গত কয়েক মাস আগে পাচারকারী শিউলী বেগম দারিদ্র্যর সুযোগ নিয়ে ৮নং ওয়ার্ডের পলি ও মর্জিনাকে সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়ে দুবাই পাঠায়। তাদের পিতা রব মিয়া এক সময় ভিক্ষুক ছিলেন। এখন দু’তলা বাড়ি হয়েছে। জানা গেছে, মাত্র ছয় মাসের জন্য তাদের দুবাই পাঠানো হয়েছে।
রয়েছে খয়ের-মলম ও ছিনতাইকারী গ্রুপ: অনুসন্ধানে জানা যায়, চনপাড়ায় খয়ের পার্টি, মলম পার্টি ও ছিনতাইকারীদের আলাদা আলাদা গ্রুপ রয়েছে। ১নং ওয়ার্ডের বাদল, ২নং ওয়ার্ডের মাইকেল খলিল, ৩নং ওয়ার্ডের বিদুৎ, ৫নং ওয়ার্ডের সোহেল, ৬নং ওয়ার্ডে দাইত্তা জামাল ও চানমিয়া এবং ৮নং ওয়ার্ডের বেস্তি লিটন, টিটু এবং মিন্টু গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ইয়াবা তৈরির কারখানা: চনপাড়ায় ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। ৩নং ওয়ার্ডে ও বেদে বহরের মাজারের পাশে ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়েছে উঠেছে। একটি সূত্র জানায়, চনপাড়া ৩নং ওয়ার্ডের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন এক বছর পূর্বে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে বার্মা থেকে ইয়াবা তৈরির ডাইস (মেশিন) কিনে আনেন। বেদে বহরের মাজারের পাশে কয়েকটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকেই ইয়াবার চালান পাঠানো হয়। এছাড়া ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে স্বপন মিয়ার। সে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে পুরাতন (সেকেন্ড হ্যান্ড) ডাইস কিনেছে বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়। এছাড়া রবিন, হাকিম ওরফে চেয়ারম্যান, জাহাঙ্গীর, ডাকাত মোস্তফা ইয়াবার ডিলার বলে জানা গেছে। এছাড়া বস্তিসহ আশপাশের সব খুনেই উঠে এসেছে মোস্তফার নাম। সূত্রটি আরো জানায়, স্বপন এক সময় ফুটপাতে বসে পিঠা বিক্রি করতো। বর্তমানে সে ইয়াবার ব্যবসা করে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। বরিশালের নিজ এলাকায় বাড়িঘর করেছে। সে পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি।
চনপাড়াজুড়ে মাদকের জাল: সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, চনপাড়াজুড়েই রয়েছে মাদকের জাল। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু চনপাড়ার মাদক ব্যবসা বন্ধ হয় না। চনপাড়াকে সবাই মাদকের হাট বলেই জানে। শুধু চনপাড়া বস্তিতেই অন্তত ৪ হাজার মাদকের মামলা রয়েছে। চনপাড়ার অবৈধ অর্থের প্রধান উৎস মাদক ব্যবসা। এখানে সব ধরনের মাদকই পাওয়া যায়। এছাড়া এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে ১নং ওয়ার্ডের হোমা, মনির, বিলকিস, চিকা মনির, আসলাম, নুর হোসেন, ৩নং ওয়ার্ডের সাহাবুদ্দিন, আবুল, বাবুল, আরিফ, তাসলী, শহিদুল, ইয়ামিন, ৪নং ওয়ার্ডের কহিনূর, জেসমিন, রফিক, ৫নং ওয়ার্ডের মিল্লাত, ৬নং ওয়ার্ডের সেলিম, দুদুর বৌ, সুরমা, স্বপ্না, কামাল, ৭নং ওয়ার্ডের আনোয়ার, পারভীন, আলম, চানপুইরা লিটন, ৮নং ওয়ার্ডের আলমগীর, জাহাঙ্গীর, খোকা, রাজিব, আমির, সুমন, মনির, ৯নং ওয়ার্ডের আলম, রোশনী, হোসেন, ল্যাংড়া শাহিন, রাজু, শামীম, রাজ। মাদকের শেল্টারদাতা হিসেবে উঠে এসেছে এখানকার রাজনীতিবিদদের নাম। চনপাড়া আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর ভাই বোতল মিজু, হাসান ও কাশেম, ফেন্সি ফারুক, কাইল্যা ফারুক, এমপি ফারুক, পাগলা দেলার, জসিম, সুলতান, খোকা, ইয়াবা রাজিব, মাইগ্যা রাজু, আসলাম,উজ্জল ও শামীম মাদকের মূল ডিলার। টেকনাফ থেকে লবণবাহী জাহাজে ইয়াবা, চট্টগ্রাম থেকে কার্গো জাহাজে বিয়ার এবং হুইস্কি, উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের ধামছি গুচ্ছগ্রাম থেকে বাংলা মদ, আখাউড়া থেকে বাইরোডে ফেন্সিডিল চনপাড়া বস্তিতে প্রবেশ করে। পরে এখান থেকে রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে।
গত ৩১ বছরে চনপাড়ায় ৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, এলাকার আধিপত্য ও দলীয় কোন্দলে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
৪৫ সুদি মহাজন: স্থানীয়রা জানান, চনপাড়ায় মাদকের পরেই সুদি ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। চনপাড়ায় রয়েছে ৪৫ জন সুদি মহাজন। এরা খেটে খাওয়া গরিব মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। এদের খপ্পরে পড়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ৮নং ওয়ার্ডের কিস্তি নাসির, ৭নং ওয়ার্ডের মনোয়ারা, ৩নং ওয়ার্ডের নূরজাহান ও ২নং ওয়ার্ডের নুরুন্নাহার ও নুরজাহান।
চনপাড়ায় রয়েছে ৬০ মক্ষিরাণী: চনপাড়া বস্তিতে বাস করে অন্তত ৬০ মক্ষিরাণী, অনুসন্ধানে জানা গেছে বস্তির ৬নং ওয়ার্ডের কুলসুম বেগম, ১নং ওয়ার্ডের খালেদা ও ঝর্ণা ও ৮নং ওয়ার্ডেও ননীতার নেতৃত্বে এ মক্ষিরাণীরা রাতের ঢাকা ও চনপাড়া রঙিন করে।
জমজমাট প্লট, সাপের বিষ ও অস্ত্র ব্যবসা: চনপাড়া বস্তির জমি ওয়াসা কর্তৃপক্ষের হলেও অবৈধভাবে খোলা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্লটের বেচাকেনা চলছে দেদার। এই ব্যবসার সঙ্গে অস্ত্র ভাড়ায় খাটানো ও বিক্রি এবং সাপের বিষের ব্যবসা চলছে বলে জানা গেছে। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, বস্তির আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান, ওসমানগণী বাবুল, চাঁনমিয়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সমসের আলী প্লট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সাপের বিষের ব্যবসা করেন বেদে বহরের রাজা লাল মিয়া, সাহা, আফজাল ও বুলু। এছাড়া অস্ত্র ভাড়ায় খাটানো এবং বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৭নং ওয়ার্ডের সোহবার, ২নং ওয়ার্ডের খাজা, ৩নং ওয়ার্ডের আলমগীর, শহিদ ও মিলন, ৪নং ওয়ার্ডের নাসির, ৬নং ওয়ার্ডের নাসির ও ৮নং ওয়ার্ডের কুতুবউদ্দিন।
ওরা বস্তির ‘রাজা’: অন্তত এক ডজন কোটিপতি রয়েছে চনপাড়া বস্তিতে। ওরা বস্তির রাজা হিসেবে পরিচিত। ওদের বস্তির ভেতরে ও বাইরে বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। কারো কারো রয়েছে রাজধানীতে একাধিক বাড়ি-গাড়ি। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য বজলুর রহমান, আবুল হোসেন, হানিফ, নাসির, জাহাঙ্গীর ও কলিমুদ্দিন কোটিপতির তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।
চনপাড়া এলাকার ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা তার বিরুদ্ধে আনীত প্লটের ব্যবসার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে আমি সাধারণ মানুষ, টুকটাক ব্যবসা করে খাই। বিরোধী পক্ষ আর জামায়াতে ইসলামের লোকজন আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।
এসব ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ইসমাইল হোসেন বলেন, চনপাড়া ছোট্ট একটি এলাকায় প্রায় পৌনে এক লাখ লোকের বসবাস। এ কারণে অপরাধের পরিসংখ্যান একটু বেশি। দেশের ছোট-বড় সব বস্তিই অপরাধ প্রবণ এলাকা। আমরা কোনো অপরাধীকে ছাড় দেই না। রূপগঞ্জ থানায় বস্তির অন্তত ৫ হাজার লোকের নামে মামলা রয়েছে বিভিন্ন অপরাধে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। আমরা প্রতিদিনই বস্তিতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | ||
6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 |
13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 |
20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 |
27 | 28 | 29 | 30 | 31 |