বাঁচতে হলে জানতেই হবে আপনি কি খাচ্ছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাউরুটি আর বন দিয়ে নাস্তা করছেন তো?। খিদে লাগলেই খাচ্ছেন নুডলস, বিস্কিট, কেক, চনাচুরসহ বেকারির তৈরী সব খাবার। কিন্তু এসব খাবার কি দিয়ে এবং কিভাবে তৈরী হচ্ছে সেটা কি জানেন। একটু খোঁজ নিন না।
আর জানলে এসব খাবার খাওয়া তো দূরের কথা; বিগত জীবনে যা খেয়েছেন তা বমি করে দিতেও ইচ্ছে করবে। এসব খাবার তৈরী মোটেই যে স্বাস্থ্যদায়ক নয়, সেটা বুঝে নিন ভেজাল বিরোধী অভিযানে প্রদত্ত জরিমানা ও সাজা থেকে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা বেকারি ও বেকারি পণ্য বিক্রীর দোকানগুলোতে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত। আদালতে সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় বেকারি পণ্যের নানা লোমহর্ষক তথ্য।
আদালত সংশ্লিষ্ট জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী সিটিজি টাইমস ডটকমে জানান, পোড়া পাম তেল, পঁচা ডিম, গরু, ছাগল, মুরগীর উচ্ছিষ্ট, ক্ষতিকর ভেজাল রাসায়নিক মেশানো ও অপরিচ্ছন্নতার অভিযোগে নগরীর লালখান বাজার হাই লেভেল রোড এলাকার নিউ সুইচ কেয়ার বেকারির কারখানাকে সম্প্রতি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত।
তিনি বলেন, খুবই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কারখানাটিতে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি করা হচ্ছিল। মেঝের ওপর ডালডা ফেলে রাখা হয়েছে। আবার সেই ডালডায় চিনি মিশিয়ে মাখন বানানো হয়। বেকারিটিতে বেশ কিছু ছত্রাক যুক্ত খাবারও পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ পণ্যের মোড়কেই উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ উল্লেখ নেই। জরিমানার পাশাপাশি এই কারখানার ৪০ লিটার পোড়া তেল ও ১৫ কেজি বেকারি পণ্য জব্দ করে পাশের নালায় ফেলে দেওয়া হয়।
নগরীর পাঁচলাইশ মোড়ের অভিজাত প্রবাসী বেকারিতে দেখা যায়, নোংরা পরিবেশেই তৈরি হচ্ছে বেকারির নানা পণ্য, কোনো পণ্যেরই নেই মেয়াদ বা উৎপাদনের তারিখ ও ওজন। ব্যবহার হচ্ছে পোড়া কালো রঙের পাম অয়েল, খালি হাতেই পণ্যে মেশানো হচ্ছে ক্রিম, মাটিতে যত্রতত্র রাখা হয়েছে ডালডা, দীর্ঘদিন খোলা অবস্থায় রাখায় এসব ডালডায় জমেছে ময়লা, ব্যবহার হচ্ছে দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত চিনির রস। এসব অনিয়মে প্রবাসী বেকারিকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও ২০ লিটার পোড়া পামঅয়েল এবং ১৫ কেজি পুরনো ডালডা নালায় ফেলে ধ্বংস করা হয়।
এভাবে প্রতিনিয়ত ভেজাল বিরোধী অভিযানে নগরীর সবকটি বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর, নিম্মামানের ভেজাল পণ্য তৈরীর অপরাধে জরিমানা করছে। পাশাপাশি বিএসটিআইয়ের আনুমোদন ছাড়াই সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিম্মমানের ভোগ্যপণ্য তৈরীর অপরাধে সাজাও দেয়া হচ্ছে।
অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশের বর্ণনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারখানার শ্রমিকরা পায়ে মাড়িয়ে ময়দা, চিনি, নিম্মমানের ভেজাল তেল দিয়ে “খামি’ তৈরী করছে। তাতে পঁচা ডিম, গরু, ছাগল, মুরগীর নাড়ী ভুড়িও মিশাচ্ছে। এ সময় শ্রমিকদের শরীরের ঘাম টপ টপ করে পড়ছে খামিতে। এছাড়া অপরিচ্ছন্ন শ্রমিকদের নাকের ময়লা ও মাথার চুলও যাচ্ছে। যা খাওয়ার সময় কোন না কোন ভোক্তার মুখে পাওয়া যায়। আর এ দৃশ্য দেখলে এসব বেকারি পণ্য খাওয়া তো দূরের কথা; বিগত জীবনে যে খেয়েছি তাও বমি করে দিতে ইচ্ছে করে।
সুূত্রমতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় চারশ‘র মতো বেকারি রয়েছে। কমবেশি এসব বেকারির সব পণ্য ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর। যা মানুষ না বুঝে প্রতিনিয়ত খাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে নানা অনুসখ-বিসুখে। ক্যাব এ সংক্রান্ত একটি তথ্যও প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বিশ্বের ১০টি মারাত্মক প্রাণঘাতি রোগ বিশেষ করে অতিরিক্ত ওজন, স্থুল স্বাস্থ্য, হাঁপানি, ক্যান্সার, মুত্রনালির সমস্যা, হৃদরোগ, কিডনি বিকলের চিকিৎসায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যায় হয়, যা বিশ্বে জিডিপির প্রায় ৮%। অথচ উৎপাদক, বাজারজাতকারী থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষই ভোক্তা। কিন্তু যারা খাদ্যে ভেজাল, ফরামালিন মিশ্রন, কেমিক্যাল দিয়ে ভেজাল পণ্য তৈরি করে মানবস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে তারাও এই ভেজাল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির রাহমান সানি এ প্রসঙ্গে সিটিজি টাইমস ডটকমে বলেন, ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর পণ্য উৎপাদনকারী বেকারির পাশাপাশি, বিএসটিআইর লাইসেন্স ব্যতিরেকে অবৈধভাবে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করছে। যেগুলোকে জরিমানাসহ সাজার আওতায়ও আনা হচ্ছে। ভ্রাম্যমান আদালতের এই অভিযান নিয়মিত চলবে বলে জানান তিনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক যোবায়ের আহমদ বলেন, খাদ্যে ভেজাল মানুষ খুনের চেয়েও মারাত্মক । বিজ্ঞানীরা যাকে ¯ে¬া পয়জন হিসেবে অভিহিত করেছেন। এটি রোধে সরকারি প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় জনগণসহ সকল মহলের সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে। তা না হলে আগামী প্রজন্ম একটি রুগ্ন, মেধাহীন ও পঙ্গু জাতিতে পরিণত হবে।
দু:খ প্রকাশ করে উপ-পরিচালক যোবায়ের আহমদ বলেন, সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জেলা প্রশাসন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএসটিআই এর নজরদারি সত্বেও এ মানববিধ্বংসী অপতৎপরতা থেমে নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। ভোক্তাদের ভোগান্তি ও প্রতারণা রোধে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করা হলেও সরকারের ব্যবসায়ী তোষননীতির কারণে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যার কারণে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর হলেও এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।