পানির দুর্গন্ধ রাজধানীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান ও বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিলে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । পাশে দিয়ে বা ভেতরের সড়ক ধরে হেঁটে চলা মানুষদেরকে প্রায়ই মুখে রুমাল ধরে চলতে দেখা যায়। ভাসমান মলমূত্র, গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ, পচা ক্ষুদ্র কচুরিপানা ইত্যাদির কারণে হাতিরঝিলের পানির রঙ ক্রমশ কালো হচ্ছে। বর্ষা শেষ হলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয় গোটা শীতকালে।

উদ্বোধনের পর থেকেই রাজধানীবাসীর উচ্ছ্বাসের জায়গা দখল করে নিয়েছিল হাতিরঝিল। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি ঢাকার বাইরে থেকে বেড়াতে আসা লোকজনও এর সৌন্দর্য একনজর দেখতে ছুটে আসেন এখানে। আর সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত ভ্রমণে তো অনেকে আসেনই। কিন্তু বর্তমানে এখানে এসে একটা বড় ধাক্কার মতো খেতে হচ্ছে এই দুর্গন্ধের কারণে।

দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে নিত্যই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাতিরঝিলের আশপাশের বাসিন্দাদের। আর প্রথমবার ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা পড়ছেন বিব্রতকর অবস্থায়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বাতাসে যে মাত্রার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, তা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে দর্শনার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।

২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি বহুল হাতিরঝিল প্রকল্পটি উদ্বোধন হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধীনে ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর  স্পেশাল ওয়ার্ক অর্গানাইজেশন। প্রায় ৩০২ একর জমির ওপর ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য বৃষ্টির পানি ও পয়োনিষ্কাশনের মাধ্যমে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতা দূর করা এবং  নগরের  নান্দনিক সৌন্দর্য় বৃদ্ধি করা। প্রকল্পে হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খালের সঙ্গে বনানী ও গুলশান লেকের সংযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রকল্পের সোনারগাঁও অংশে ঝিলের মাঝে বিষফোঁড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিজিএমইএ ভবন হাতিরঝিলের পুরো সৌন্দর্য প্রকাশের পথে বাধা বলে সমালোচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ভবনটি ভাঙার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ভবনটি ভাঙা-না ভাঙার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলো।

দীর্ঘ লড়াইয়ে হাতিরঝিলের ‘বিষঁফোড়া’টি উচ্ছেদ হচ্ছে বটে, কিন্তু অন্যদিকে এর পানিতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে পরিবেশ হয়ে উঠছে পুঁতিগন্ধময়। প্রকল্পের ভেতরে বসছে দোকান। চারপাশে ছড়াচ্ছে ময়লা আবর্জনা।

সরজমিনে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ও তরুণ প্রাতর্ভ্রমণ বা ব্যায়াম করতে ছুটে আসেন হাতিরঝিলের বিভিন্ন পয়েন্টে। তাদের অনেকের মুখে থাকে মা্স্ক পরা। মুক্ত বায়ু সেবনের জন্য গড়ে ওঠা হাতিরঝিলে এসে মুখ খোলা রাখা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেন অনেকে।

তারা জানান, রাজধানীতে খুব একটা খোলামেলা জায়গা না থাকায় তারা প্রতিদিন ভোরে হাতিরঝিলে  আসেন। কিন্তু হাতিরঝিলের পানি এত দুর্গন্ধ ছড়ায় যে, এখানে আসতে মন সায় দেয় না অনেক সময়। কিন্তু বিকল্প কম বলে বাধ্য হয়ে মাস্ক পরে আসেন তারা।

রামপুরার উলন রোডের পঞ্চাশোর্ধ বয়সী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাতিরঝিলে একে তো দূষিত পানির দুর্গন্ধ, তার ওপর মহানগরী ও মধুবাগসংলগ্ন হাতিরঝিল সেতুর ওপর দোকান বসানো হয়েছে। এর ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে। এতে হাতিরঝিলের জল-স্থল দুই-ই নোংরা হচ্ছে। মাছি ও পোকামাকড়ে ভরে যাচ্ছে আশপাশ।’ পরিবেশ যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে আর কদিন পর এখানে প্রাতর্ভ্রমণ কিংবা ব্যায়াম করতে আসা স্বস্তির হবে না বলে আশঙ্কা করেন তিনি।

দোকানের আবর্জনায় পরিবেশ নোংরা হওয়ার বিষয়ে তারা কিছু বলেন কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি এটা নাকি সরকার আর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তাই দোকানদারকে আমরা কিছু বলার সাহস করি না।’

মহানগরীর আরিফুর রহমান এবং রামপুরার আহসানও পানি ও ভাসমান খাবারের দোকানের দিকে ইশারা করে বলেন, দিন দিন হাতিরঝিল যদি এ রকম নোংরা হতে থাকে আর সরকার এর কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তবে হাতিরঝিল  তার নান্দনিক সৌন্দর্য হারাবে অচিরেই।

বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একদল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মন ও শরীর ভালো রাখতে একটু মুক্ত হাওয়ার খোঁজে তারা বন্ধুরা মিলে হাতিরঝিল ঘুরতে আসেন। আগে যত ভালো পরিবেশ ছিল, এখন আর সেটা নেই। নোংরা পানির দুর্গন্ধ ও দূষিত পরিবেশের কারণে তারা অস্বস্তি বোধ করেন। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আর এখানে আসতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তারা।

বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে আসা পাঁচ বছরের ছোট্ট জেরিনও এখন হাতিরঝিলকে ভয় পায়। ‘গন্ধ-গন্ধ’ বলে কান্না জুড়ে দিয়ে বাবা-মাকে তাড়া দেয় জায়গা বদল করে অন্য কোথাও যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়, দুর্গন্ধ যে প্রায় সবখানে। খাবার-খেলনার লোভ দেখিয়েও তাকে হাতিরঝিলে বেশিক্ষণ রাখতে পারেন না বাবা-মা ।

দূষিত পরিবেশ নিয়ে অস্বস্তি আর শঙ্কা থাকলেও রাজধানীর এই দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র  নিয়ে কিন্তু  গর্বও করেন দর্শনার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। সরকারের প্রতি তাদের অনুরোধ, দূষিত পানি পরিষ্কার এবং ভাসমান খাবার দোকান যেন হাতিরঝিলের বাইরে স্থাপন করা হয়। একদিন  হাতিরঝিল দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।

এ বিষ‌য়ে হা‌তির‌ঝিল প্রকল্পের প‌রিচালক মেজর কাজী শা‌কিল আহ‌মেদের সঙ্গে যোগ‌যোগ করলে জানা যায়, তিনি বর্তমা‌নে ছু‌টি‌তে আছেন। পরে মোবাইল ফো‌নে যোগা‌যো‌গের চেষ্টা কর‌লেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031