চরম ঝুঁকিতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলজুড়ে গড়ে তোলা সব কটি শিপ ব্রেকিং (জাহাজ ভাঙা) ইয়ার্ড । নীতিমালার তোয়াক্কা না করায় এসব ইয়ার্ডে একের পর এক ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সরকার এটিকে শিল্প ঘোষণা করার পরও এসব ইয়ার্ডে গড়ে তোলা হয়নি কোনোরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ফলে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এখানকার শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন ধরে এসব শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিক মারা যাওয়ায় সরকার এই শিল্পকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসে।
নীতিমালার শর্তসমূহে পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। শর্ত পূরণ ছাড়া জাহাজ আমদানিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞায় প্রায় দুই বছর স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকে। ফলে জাহাজ ভাঙা শিল্প ঝিমিয়ে পড়ে।
পরে জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ইয়ার্ডগুলো পুনরায় উজ্জীবিত হয়। কিন্তু এসব ইয়ার্ডে নীতিমালার শর্ত পূরণ না করে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা এলাকায় লিজান হুল্ডিংস নামে একটি শিপইয়ার্ডে কাজ করার সময় জাহাজ থেকে পড়ে মহসিন (৪০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২৪ অক্টোবর উপজেলার মাদামবিবির হাট এলাকায় এস ট্রেডিং করপোরেশন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে গ্যাস বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাইদুর রহমান (৩০) নামে এক শ্রমিক নিহত হন।
১৮ অক্টোবর উপজেলার কদম রসূলস্থ আরেফিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি শিপ ইয়ার্ডে কাটার জন্য আনা জাহাজে গ্যাস আক্রান্ত হয়ে তিন শ্রমিক মারা যায়। ৪ অক্টোবর অপর একটি ইয়ার্ডে মারা যান দুই শ্রমিক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সীতাকুন্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২০টি ইয়ার্ডের মধ্যে কিছু কিছু ইয়ার্ড নীতিমালা মানলেও অধিকাংশই মানছে না। যে কারণে ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। একই সাথে মানবেতর জীবন যাপন করছে জাহাজ ভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার শ্রমিক।
সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ ইয়ার্ডে শ্রমিকদের চিকিৎসা, আবাসন ও নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি ইয়ার্ডে শিশু শ্রমিকের আধিক্য রয়েছে। রাতের আঁধারে জাহাজ কাটা চলছে হরদম। দুর্ঘটনা ও অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবায় ডাক্তার ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা নেই।
স্থানীয় লোকজন জানান, কর্মরত শ্রমিকরা বসবাস করে ইয়ার্ডের বাইরে ছোট ছোট ঝুপড়িতে। সেখানে নেই পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিছন্নতা, পুষ্টিকর খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ।
শ্রমিকরা জানান, অভাবের তাড়নায় ছোট একটি কক্ষে ২০-৩০ জন শ্রমিক গাদাগাদি করে থাকতে হয়। একটি টয়লেট ও একটি নলকূপ ১৫-২০ পরিবার ব্যবহার করে। এসব ইয়ার্ডে শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন তারা জেলখানার কয়েদীর জীবন যাপন করছে।
নীতিমালা প্রসঙ্গে শিপ ব্রেকিং ফ্লাটফর্ম বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ইপসা-র এডভোকেসি ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী শাহীন ঢাকটাইমসকে বলেন, শিপ ব্রেকিং নীতিমালা তৈরির জন্য হাইকোর্ট পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। অপরদিকে সরকার এ ব্যাপারে শিল্পমন্ত্রণালয়কে নীতিমালা করতে বলে। ফলে দ্বৈত সিদ্ধান্তের কারণে নীতিমালা বাস্তবায়ন আটকে যায়। পরে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টকে দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে একটি নীতিমালা তৈরি করতে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, শিপ ব্রেকিং-এ নীতিমালা বাস্তবায়নে মালিক পক্ষ, প্রশাসন ও এনজিওসহ সব প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের কথা থাকলেও মালিক পক্ষের অসহযোগিতার কারণে তা হয়নি। ফলে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে প্রাণহানির ঘটনাও বাড়ছে।
এ বিষয়ে সীতাকুন্ড মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হাকিম আবু বক্কর সিদ্দিকি ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিশ্বের কোথাও শ্রমিকদের প্রতি এত অন্যায় অবিচার হয় না। বেকারত্বের কারণে বিপদজনক অবস্থায় এই শিল্পে শ্রমিকরা কাজ করছে। শ্রমিক সংগঠন না থাকায় দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিকরা কোনো ধরনের আন্দোলন করতে পারে না।
কদম রসুল এলাকায় অবস্থিত তানহা স্টিলের মালিক কুসুম জানান, ইয়ার্ডটি নতুন করে চালু করা হয়েছে। তাই নীতিমালার অনেক বিষয় সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে খুব শিগগির সব শর্ত পূরণ করা হবে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ইয়ার্ড মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের কথা বলে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। অথচ নীতিমালার শর্ত পূরণ না হওয়ায় দুর্ঘটনা ও অসুস্থতায় প্রতি বছর অসংখ্য শ্রমিক মারা যাচ্ছে এসব ইয়ার্ডে। শ্রমিক ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে শিল্প মন্ত্রণালয় ৬০টি শর্তসাপেক্ষে ইয়ার্ড পরিচালনার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ ও তদারকি না থাকায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে কোনো পরিবর্তন আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং এসোশিয়েশন-বিএসবিএর অধীনে শ্রমিকদের যে প্রশিক্ষণের কথা রয়েছে তা নামে মাত্র। ভাটিয়ারী এলাকায় বিএসবিএর একটি হাসপাতাল থাকলেও তা আজও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি।
এ বিষয়ে বিএসবিএ-র সভাপতি হেফাজেতুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, বর্তমানে ইয়ার্ডগুলো সবধরনের নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছে। তারপরও কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে, তা খুব দ্রুত সমাধান করা হবে।