নেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। গাড়িগুলো সারি সারি দাঁড় করানো রাস্তার দু’পাশে। রাস্তার অর্ধেকটাজুড়ে ময়লার ভাগাড়।বাজার বসেছে, তাও রাস্তা দখল করে। যত্রতত্র রিকশা চলছে। যাত্রী ওঠা-নামার সময় বাসগুলো এমনভাবে আড়াআড়ি থাকে যেন পেছন থেকে কোনো গাড়ি অতিক্রম করে সামনে যেতে না পারে। হর্নের পর হর্ন। কান ঝালাপালা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নির্মাণসামগ্রীও রাখা আছে কোথাও কোথাও। আবার রাস্তার মাঝখানে টিন দিয়ে ঘিরে চলছে উন্নয়নকাজ। ইউলুপ হচ্ছে। দোকানপাট আর ফুটপাত একাকার। বোঝার উপায় নেই কোনটা হাঁটার পথ আর কোনটা পসরাখানা। তার ওপর পথচারীর কারণে বিড়ম্বনা তো আছেই। যেখান সেখানে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে রাস্তা পারাপার। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে উপায় থাকে না। ফুটওভার ব্রিজ নেই। জেব্রা ক্রসিং কী, তাও অনেকের অজানা। এত সব বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, হ-য-ব-র-ল ঢাকার একটি রাস্তার চিত্র। নগরীর ব্যস্ততম একটি রাস্তা। যেখানে মানুষ আর গাড়ির জটলা লেগে থাকে সব সময়।
এত বর্ণনার পর হয়তো মৌচাক থেকে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, বসুন্ধরা হয়ে কুড়িল পর্যন্ত পথটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার হবে না। বলতে হবে না প্রগতি সরণির কথা। নগরীতে এমন দুরবস্থা অন্য কোনো রাস্তায় আছে কি না জানা নেই। এ পথে যারা নিয়মিত চলাচল করেন তাদের কাছে নেহাত ‘নরক-যাত্রা’। ভোরের আলো ফোটার আগে শুরু হয় যানজট। কোনো কোনো সময় রাত ১২টা পর্যন্ত থাকে এ জট। ‘এমনটা হবেই না কেন? এ পথে কোনো শৃঙ্খলা আছে?’ তৌহিদুল ইসলাম। বেসরকারি চাকরিজীবী বলছিলেন। ‘ট্রাক চলছে হরদম। ভারী কাভার্ড ভ্যান তো কথাই নেই। কোনো নিষেধ-বারণ কেউ শোনে?’
মৌচাক টু মালিবাগ রেলগেট, নগরীর বুকে এক টুকরো খাল!
উড়ালসড়ক হচ্ছে, ভালো। মৌচাক-মালিবাগের যানজট বলতে কিছু থাকবে না, যখন খুলে দেওয়া হবে উড়ালসড়ক−তা সুখবর। সময় লাগবে। কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। কম করে হলেও সব ধুয়েমুছে নামতে আরও দশ মাস। তাই বলে এত দিন? মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট যাওয়ার রাস্তাটার দুরবস্থার চিত্র বর্ণনায় পুরোপুরি উঠে আসবে না। বৃষ্টি হোক বা না হোক হাঁটুপানি থৈথৈ করে পথটিতে। বড় বড় খানাখন্দ। প্রাইভেট কারগুলো ডুবুডুবু। বাসগুলো উল্টে যায় যায় ভাব। রিকশা টেনে যারা জীবন চালান তাদের দফারফা। ‘উফ্, এটা কি ঢাকার রাস্তা?’ সুপ্রভাত স্পেশালের যাত্রী শাকিলের প্রশ্ন? সিট থেকে পড়ে যেতে যেতে উঠে বসলেন এক মধ্যবয়সী যাত্রী। বললেন, ‘ওপরে উড়ালসড়কের কাজ চলছে, চলুক না। তাই বলে এখন যারা নিচ দিয়ে চলাচল করছেন তাদের অসুবিধা কেউ দেখবে না?’ রামপুরা টিভি সেন্টারের আগ পর্যন্ত পুরো পথটারই করুণ দশা।
বাজারে না গিয়েও বাজার করা যায় রামপুরায়!
রামপুরা থেকে বাজার করতে বাজারে যেতে হয় না। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কিভাবে? রামপুরা বাজারের কাছাকাছি রাস্তার ওপরেই মিলবে মাছ, মুরগি, শাকসবজির দোকান। অবস্থা দেখে মনে হবে, চলাচলের জন্য নয় জিনিসপত্রের পসরার জন্য তৈরি হয়েছে পথ। ঠিক রাস্তার মাঝখানে এসে সবজির ডালা নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতা। তার পাশে মাছের হাঁড়ি। আর মুরগি কাটাকুটির কাজ চলছে রাস্তার ওপর। কোনো পথচারী যদি ধাক্কা খান দোকানিদের, সঙ্গে উল্টো কথা শুনতে হবে। হয়তো দেখা যাবে কোনো দোকানি খেঁকিয়ে উঠে বলছেন, ‘দেখে চলতে পারেন না? এইখান দিয়া হাঁটেন কেন?’ তখন চোখ কপালে না তুলে আস্তে সরে আসাই শ্রেয়। নয়তো অপমানিত হতে হবে। বড় বড় গর্ত, জলাবদ্ধতা কিংবা ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার জন্যই যে এ পথে যানজট তৈরি হয়, ভুল কথা। রাস্তা দখল করে দেদার বাণিজ্যও এজন্য দায়ী। প্রমাণ পেতে ওই পথে ঘুরে এলেই হয়।
মেরুলে ‘ইউ’ ভোগান্তি
ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে কোনোমতে এসে উঠলেন রামপুরার রাস্তায়। বনশ্রীর ইউলুপ থেকে যে পথ নেমে গেছে হাতিরঝিলের কোল ঘেঁষে। ভেবেছেন ভোগান্তি শেষ? মোটেও না। ভোগান্তির নতুন রূপ হাতছানি দিচ্ছে সামনে। হাতিরঝিল থেকে যে পথ এসে মিলেছে মেরুল বাড্ডার পথে, ভোগান্তির শুরু সেখান থেকে। কয়েক গজ দূরে টিন দিয়ে ঘেরা আছে রাস্তার বড় একটি অংশ। জানা না থাকলে লোকের কাছে জানতে চাইতে পারেন। ‘এখানে কী হচ্ছে ভাই?’ জবাব পাবেন। ‘ইউলুপ হচ্ছে।’ ওই পথে গাড়ির আসা-যাওয়া একই পথে। সোজা যেতে পারবেন না। ‘ইউ’ সদৃশ বাঁক ঘুরে পার হতে হবে। পার হলে অপেক্ষা করছে নতুন অভিজ্ঞতা।
পথের মাঝে ময়লার স্তূপ
পথের মাঝখানে কিভাবে ময়লা-আবর্জনা স্তূপ করে রাখতে হয় মেরুল বাড্ডা গেলে তাও দেখা যায়। যানজট তো আছেই। বাসে বসে আছেন। বাস গিয়ে ঠিক দাঁড়াল ভাগাড়ের সামনে। জানালা দিয়ে ভগভগিয়ে ঢোকা দুর্গন্ধটা গা গুলিয়ে দেবে মুহূর্তেই। অনেকে সহ্য না করতে পেরে ভেতরে থেকে কিছু বের করে দিলে…। অপেক্ষা করুন। সহ্যশক্তির চরম পরীক্ষা দিতে হবে আপনাকে। যানজট ঠেলে টুকটুক করে উত্তর বাড্ডায় এলে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। কারণ মেরুলের ভাগাড় উত্তর বাড্ডার আবর্জনার স্তূপের তুলনায় কিছুই নয়। দিন দিন এ ভোগান্তি বাড়ছে। নগরীর ব্যস্ততম সড়কের বেহাল দশা আর কতকাল?
নতুনবাজারে পুরোনো জট
নতুনবাজার থেকে সোজা পথ চলে গেছে কুড়িল বিশ্বরোডের দিকে। বলা সহজ। তবে সোজা পার হয়ে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। বাড্ডার পর শাহজাদপুর পর্যন্ত এক টানে কোনো গাড়ি পার হবে, এটা ভাব এই অবস্থা নেই। রাস্তার ওপর বাঁশের স্তূপ। কোথাও নির্মাণসামগ্রীর দোকানের সামনে সরঞ্জাম রাখা। আবার একটু পথ এগোলে পার্ক করা বাসের লম্বা সারি। রামপুরা থেকে মিরপুরের পথে চলাচলকারী পরিবহনগুলো দিন শেষে এখানে এসেই ক্ষ্যান্ত হয়। পথের অর্ধেকটা থাকে তাদের দখলে। বাকি সরু পথে যান চলে ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে। বিপরীত পাশে পুরোনো আসবাবে দোকান ঘেঁষে রাস্তা কেটে কাজ চলছে। পথটা কম নয়। গুলশান-২ হয়ে আমেরিকান দূতাবাসের পাশ দিয়ে মাদানী সড়ক হয়ে প্রগতি সরণিতে ওঠার মুখ নতুনবাজার। ঢোকার পথও একটাই। যে কারণে ওই পথে যানজট বেশ পুরোনো। এই জট ঠেলে নর্দ্দার পথ পার হতে পারলেও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ঢোকার পথে থামতে হবেই। বাকিটা পথ হয়তো ভালোয় ভালোয় পার হতে পারবেন। তবে দ্বিতীয়বার এ পথে ফেরার ইচ্ছে জাগবে না−বলা যায় জোর দিয়েই। অসুবিধা নেই কুড়িল উড়ালসড়ক খোলা আছে। সোজা উঠে গেলেই বেঁচে গেলেন। আর যারা নিত্যদিন এ পথে চলেন? তারা? তাদের কথা কেউ কি ভাবেন? নন্দিত নরকপথে যাত্রা আর কতকাল?