যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক। পেশায় আইনজীবী।তবে তাঁর উদ্ভাবিত ‘ক্রাইমসিন রোভার’ তুমুল আলোড়ন ফেলেছে সারা বিশ্বে। এই রোবটটি ৩৬০ ডিগ্রি কোণ থেকে দুর্ঘটনাস্থল নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত করতে পারে। ‘ক্রাইম ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে চাই’ শীর্ষক মেহযেব রহমান চৌধুরীর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যায়-
ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল এমন কিছু একটা করব, যার মাধ্যমে সারা পৃথিবী উপকৃত হবে। যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেনসিক সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের ওপর পিএইচডি করার সময় ইউরোপ-আমেরিকাসহ ৫০টি পুলিশ ফোর্স ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। তখন আমি অনুভব করি, বর্তমান প্রযুক্তিতে যে স্থানে অপরাধ সংঘটিত হয় (crime scene), সে জায়গা এবং আলামতের সঠিক চিত্র ধারণ করা সম্ভব হয় না। গবেষণা করে দেখলাম, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যাতে করে পূর্ণাঙ্গভাবে অপরাধ সংঘটনস্থল সংরক্ষণ করা যায়। মঙ্গলগ্রহে নাসার রোবটিক রোভারের একটি প্রতিবেদন টিভিতে দেখার পর অনুপ্রাণিত হলাম। এরপর শুরু করলাম গবেষণার কাজ। মহাকাশের প্রযুক্তি কীভাবে পৃথিবীতে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবনা শুরু হলো। এক মাসের মধ্যেই তৈরি করে ফেললাম বিশ্বের প্রথম ‘ক্রাইমসিন রোভার’, যা ৩৬০ ডিগ্রি কোণ থেকে ঘটনাস্থল নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত করতে পারে। আমি নিজে একজন ব্যারিস্টার। আদালতে প্র্যাকটিস করার সময় লক্ষ করেছি, যেহেতু জুরি বা বিচারক অপরাধস্থল প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন করতে পারেন না, সে কারণে অনেক সময় মূল অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমার এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিচারকেরা ঘটনাস্থলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সহায়তায় দেখতে পারবেন। এতে করে মানুষ আরও নিখুঁত বিচার পাবে।
রোভার বানানো ছিল বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জ। এটা বানাতে হলে যন্ত্রাংশের প্রয়োজন। ইংল্যান্ডে তা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এখানে সবকিছু পাওয়া যাবে না। ইতালি, চীন ও ফ্রান্স থেকে আনতে হবে। সমস্যা তখন দেখা দিল কীভাবে ভিন্ন দেশের ভিন্ন কোম্পানির মাইক্রো কন্ট্রোলার বোর্ডকে সংযুক্ত করা যাবে। এখানে শুধু হার্ডওয়্যার নয়, সফটওয়্যারও একটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারলাম, দুটো মাইক্রো কন্ট্রোলার বোর্ডের কাজ ভাগ করা ছাড়া হয়তো বা সফল হব না। একটা বোর্ড শুধু নেভিগেশনের কাজ করবে; যা সেন্সরের মাধ্যমে রোবটকে পরিচালিত করবে। গুগলের সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির মতো এটা কোনো রিমোট কন্ট্রোল ছাড়াই চলবে। আরেকটি মাইক্রো কন্ট্রোলার কাজ করবে ভিডিও এবং থ্রিডি ইমেজ প্রসেসিংয়ের জন্য। ৩৬০ ডিগ্রি কোণে দৃশ্য ধারণ করতে পারবে—এমন একটা ক্যামেরারও প্রয়োজন ছিল। বাজারে যেসব ক্যামেরা পাওয়া যায়, তা ব্যয়বহুল অথবা নিম্নমানের। তখন আমি চীন থেকে একটা স্বল্পদামি ক্যামেরা এনে রূপান্তর করলাম। জাপান থেকে সনির সিমোস সেন্সর এনে সংযুক্ত করলাম চীনা ক্যামেরার ফ্রেমে।
ক্রাইমসিন ইমেজিংয়ের জন্য এর আগে এ ধরনের কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার না হওয়ার কারণে সফটওয়্যারও সহজলভ্য ছিল না। সে জন্য আমাকেই এই প্রোগ্রামিং করতে হয়েছে। সব সিস্টেমকে যুক্ত করার পর ভয় হচ্ছিল, তা একসঙ্গে কাজ করবে কি না। এরপর ঘরের মধ্যে একটি ডামি ক্রাইমসিন বানিয়ে তা পরীক্ষা করলাম। দেখলাম সঠিকভাবেই কাজ করছে।
আগেই বলেছি, আমি ইঞ্জিনিয়ার নই। বিজ্ঞান নিয়ে কখনো পড়ালেখাও করিনি। আমাকে কারিগরি বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করারও কেউ ছিল না। ৩৬০ ডিগ্রি কোণে দৃশ্য ধারণ করার মতো প্রযুক্তি কনজ্যুমার মার্কেটেই পুরোপুরি নতুন। যে কারণে আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটাকে গ্রহণ করবে কি না। তা ছাড়া, ধারণকৃত ফুটেজ কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সেটাও ছিল আরেকটা চ্যালেঞ্জ। আমার ভেতরে একটা স্বপ্ন কাজ করছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম ও একক প্রচেষ্টায় এই রোবটটি তৈরি করেছি। এ ধরনের একটি প্রকল্প তৈরিতে দরকার প্রচুর অর্থের। যেটুকু করেছি, সবটুকু আমার পরিবারের সহায়তায়।
রোবট তৈরি করার পর নিজে নিজেই ভাবতে থাকলাম, এ ধরনের একটি আবিষ্কার বা উদ্ভাবন যদি মানুষ নাই–বা জানে, তখন এটা অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই বিলেতের বিখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা ওয়েবসাইট ‘দ্য কনভারসেশনে’ একটি নিবন্ধ পাঠাই। তারা এই গবেষণাপত্রটি লুফে নেয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নিবন্ধটি প্রকাশ হয়। এ ব্যাপারে অবশ্য দ্য কনভারসেশনের কমিশনিং এডিটর স্টিফেন হ্যারিসকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর দূরদর্শিতায় আমার এই উদ্ভাবন দুনিয়ার কাছে পৌঁছে যায় মুহূর্তের মধ্যে। যা কিনা ইংরেজি, ফরাসি, চীনা, রুশ, জার্মান, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ান, বাংলাসহ বহু ভাষায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ব্রিটেনের দ্য টাইমস, ডেইলি মেইল, দ্য আই, বিজনেস ইনসাইডার, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়্যারড ম্যাগাজিন, রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত রেডিও স্পুটনিক, ডিসকভারি চ্যানেল ছাড়াও ১২০০ সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি পুলিশ ফোর্স আমাকে সরাসরি আমন্ত্রণ জানায়। তারা আমার তৈরি করা রোভারটি কাজে লাগাতে চায়। শুধু তা-ই নয়, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বিচারক, আইনজীবী, গবেষকেরা আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে আমাকে ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান উৎসব ‘ম্যানচেস্টার সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে’ আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তাতে যোগ দিই। সেখানে ১০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে রোভার এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ফুটেজ প্রদর্শন করি। গর্বের বিষয় হলো, নাসা থেকেও আমাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে এই প্রজেক্ট শুরু করার পর।
আমার স্বপ্ন হচ্ছে, এই প্রযুক্তি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। এখন যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, তা জটিল ও ব্যয়বহুল। শতকরা ১ ভাগ পুলিশ ফোর্সও তা ব্যবহার করতে পারে না। বর্তমানে পুলিশ যেটা ব্যবহার করে, তাতে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৭৫ হাজার ডলার। আমার এ রোভারে খরচ পড়বে মাত্র ৫০০ ডলার, যা আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব। মহাকাশে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হয় তা পৃথিবীতে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করার ইচ্ছা আছে।
দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি আমি। বেসরকারি খাতে একটা ক্রাইম ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সবাই জানেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো বিপর্যয়ের পর তিন বছরেও নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ টেস্ট পুরোপুরি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আমাদের দেশের ফরেনসিক অবকাঠামো এখনো উন্নত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এটা আধুনিকায়ন করা জরুরি। শুধু তা–ই নয়, আমাদের দেশে এ নিয়ে গবেষণার সুযোগও কম। ডিএনএ টেস্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফিঙ্গার প্রিন্টিং, ডিজিটাল ইমেজিং এবং ট্রেস এভিডেন্স বিশ্লেষণ উন্নত বিশ্বের মতো দক্ষতাসম্পন্ন একটি ল্যাব তৈরি করতে চাই। যেখানে হবে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা। যেখানে দরিদ্ররা সেবা পাবে বিনা মূল্যে।
(ব্যারিস্টার মেহযেব রহমান চৌধুরী মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর একমাত্র সন্তান)