সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে সাগর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে। এর ফলে সাগর উত্তাল রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের শনিবার ঘোষিত । ওমান এই ঘূর্ণিঝড়টির নাম দিয়েছে ‘নাডা’। এর ফলে এক সপ্তাহেই দুটো ঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে।
আবহাওয়া অফিসের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি সামান্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। তবে এটি নিম্নচাপ থেকে দ্রুত গভীর নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। এটি আজ শনিবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬৫ কি.মি. পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩৫ কি.মি. পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮০০ কি. মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮২০ কি. মি. দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। নিম্নচাপটির প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
এতে বলা হয়, গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কি.মি. যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সমূহকে চার নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
শনিবার আবহাওয়ার ওই বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
এতে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাগরে না নামতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছধরা নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’র প্রভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা এলাকাতেও গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কলকাতার সংবাদমাধ্যমগুলো ভারতের দিল্লির মৌসম ভবনের সাইক্লোন সতর্কতা বিভাগের অধিকর্তা এম মহাপাত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ‘নাডার গতিপথের গাণিতিক সমীকরণ বলছে, শনিবার-রবিবার সামুদ্রিক ঝড় নাডা বাংলাদেশ উপকূলে আছড়ে পড়বে। নাডার কারণে আগামী শুক্র থেকে রবিবার অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশার উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।’
বরিশালে ছোট লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, সাগরে ঘূর্ণিঝড় ’নাডা’র কারণে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে বৈরী আবহাওয়ায় বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
শনিবার বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক আজমুল হুদা সরকার (মিঠু) বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরগুলোতে আবহাওয়া অধিদফতর ২নং সতর্ক সংকেত জারি করায় বরিশাল নৌবন্দরের ৬৫ ফুটের নিচের লঞ্চ এম এল বিসমিল্লাহ্ ও এম এল লিমা-২ এর যাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্ক সংকেত ওঠা না পর্যন্ত এ নির্দেশ বলবৎ থাকবে।
মিঠু সরকার আরও জানান, সকাল ৭টায় বরিশাল নৌ বন্দর থেকে ভোলার ভেদুরিয়ার উদ্দেশ্যে বিসমিল্লাহ্ লঞ্চটি ছেড়ে গেলেও সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লঞ্চটির যাত্রা স্থগিত ঘোষণা করা হয় এবং বর্তমানে লঞ্চটি একটি ঘাটে নোঙ্গর করা রয়েছে।
তিনি জানান, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে সকাল ৮ টা থেকে ৬৫ ফুটের চেয়ে ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ রুটের অন্যান্য লঞ্চগুলোকেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে নদীপথে চলাচলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। লঞ্চ চলাচলের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানান তিনি।
এদিকে বৃষ্টির ফলে বরিশাল নগরীর হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাটেও যানবাহন ও মানুষজনের চলাচল ছিল নিতান্তই কম।
অপরদিকে আবহাওয়ার বিষয়ে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ’নাডা’র কারণে সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে বরিশালে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১২.০১ মিলিমিটার।
তিনি জানান, বরিশালের নদী বন্দরগুলোতে ২নং সতর্ক সংকেত এবং নিকটবর্তী পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৩নং সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে।
আনিসুর রহমান আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় ’নাডা’ পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৮২০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পশ্চিমাংশে অবস্থান করছে।
সেন্টমার্টিনে আটকা পড়েছে শতাধিক পর্যটক
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’র প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিনে শতাধিক পর্যটক আটকা পড়ে আছে। এর আগে শুক্রবার টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর মাধ্যমে দুইশতাধিক পর্যটককে সেন্টমার্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরমধ্যে ১শ’ ২৭ জন পর্যটক টেকনাফে ফিরে এলেও আজ শনিবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আরও শতাধিক পর্যটক সেন্টমার্টিনে আটকা পড়ে আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমদ জানান, শুক্রবার ৩নং সংকেত চলাকালীন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সেন্টমার্টিনের হোটেল-মোটেল ও বাজারে পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে অবস্থান না করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। তারপরও শতাধিক পর্যটক আটকা পড়ে আছে।
সেন্টমার্টিন সার্ভিস বোট মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর জানান, আটকা পড়া পর্যটকদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার সকালে ২টি ও বিকালে আরও ১টি ট্রলারে মোট ১২৭ জন টেকনাফে ফিরে যায়। তারপরও শ’খানেক পর্যটক বিভিন্ন হোটেল মোটেলে অবস্থান করছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম জানান, আটকা পড়া পর্যটকদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে এবং নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের প্রধান কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’র কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৫৫ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এ কারণে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর সমুহকে ৩নং সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থারত মাছ ধরার সকল নৌযানকে উপকুলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে। এর প্রভাবে সাগরে উত্তাল রয়েছে।
পটুয়াখালীতে বৈরী আবহাওয়া, বৃষ্টি অব্যাহত
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃস্ট নিম্নচাপ ও সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। আজ শনিবার সকাল থেকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে জেলার সবখানে। শুক্রবার ভোররাত থেকে পুরো জেলায় শুরু হয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। পায়রা সমুন্দ্র বন্দরকে ৩ নম্বর সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। এদিকে নদী বন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। তবে জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। মহিপুর-আলীপুর-ঢোস-মৌডুবিসহ জেলার সকল মৎস্য বন্দরের বেশির ভাগ মাছধরা ট্রলার তীরে ফিরতে শুরু করেছে। কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগর উত্তাল রয়েছে।
পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার ও ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। কলাপাড়া রাডার স্টেশন ইনচার্জ প্রকৌশলী শাহ আলম জানান, সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি আজ সকাল ৬টায় পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮শ’ ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর দূরবর্তী সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সাগর উত্তাল রয়েছে। জেলেদের নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।