জীবন-মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। চিকিৎসাসেবার নামে অনৈতিক বাণিজ্য। রাজধানীসহ সারা দেশে যেখানে সেখানে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও হাসপাতালে এই ব্যবসা চলছে দেদারছে। আর এতে প্রতিনিয়তই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সহজ-সরল রোগী ও তার পরিবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এ শ্রেণির অসাধু ক্লিনিক মালিক, ভুয়া ডাক্তার ও দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান। শুধু অর্থই নয়, চলে রোগীদের জীবন নিয়ে খেলাও। কোনো কোনো ক্লিনিকে চিকিৎসকের কাজ করেন নার্সরা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যাথলজিস্ট ছাড়াই চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। দেয়াল ফুটো করার ড্রিল মেশিন দিয়ে রোগীকে অপারেশন করার ঘটনাও ঘটেছে। আর চিকিৎসাসেবায় দেশে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড যে শুধু ছোট ছোট ক্লিনিক ও হাসপাতালই বা অখ্যাত প্রতিষ্ঠান করছে না তা নয়, সমপ্রতি দেশের নামি-দামি বহু ডায়াগনিস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন। মোবাইল কোর্টের অভিযানে জরিমানাও গুনতে হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে। তবুও থেমে নেই তারা।
গত ২১শে সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২২ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পুরান ঢাকার মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালকে এই জরিমানা করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক উপাদান দিয়ে রোগ নির্ণয়সহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এই জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সরওয়ার আলম। র্যাব-২ এর উপ-পরিচালক মো. মাহবুব আলম গণমাধ্যমকে জানান, পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডে মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেসে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন ডায়ানস্টিক টেস্টের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট কার্ড হিসাবে ব্যবহৃত বইয়ে ১৫টি পাতায় ব্যাংক স্বাক্ষর করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নামে ভুয়া সিল জব্দ করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার নাসির ওয়াকার, ল্যাব ইনচার্জ উজ্জ্বল মিয়া, ম্যানেজার (এডমিন) সাইফুল ইসলাম এবং কেয়ারটেকার আবু ইয়াহিয়াকে আট লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাহবুব আলম আরো জানান, একই এলাকায় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার শিবলী সাদি আকন্দ, আবুল কালাম আজাদ ও মো. রবিকুল ইসলামকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই অপরাধে মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার খোকন চৌধুরী, ল্যাব ইনচার্জ মাহফুজ ভুঁইয়া ও টেকনোলজিস্ট মিলন চৌধুরীকে চার লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। এরপর একই এলাকার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান ল্যাবে মেয়াদ উত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার, অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে ল্যাব পরিচালনা করা এবং অনুমোদন বিহীন ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির ল্যাব ইনচার্জ সুলতান এম আতিকুর রহমান এবং টেকনোলজিস্ট মো. জিয়াউর রহমানকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সরওয়ার আলম মানবজমিনকে বলেন, গত এক বছরে তারা সারা দেশে তিনশ’ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ডসহ নানা শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, অনিয়মের কারণে গত অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং ঢাকার ট্রমা সেন্টারকে সেপ্টেম্বরে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ ধরনের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেসের ম্যানেজার নাসির ওয়াকার জানান, তারা এখন অনেক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন। গুণগত দিকে তাদের যথেষ্ট মনোযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি শতভাগ নিশ্চিয়তা দিয়ে বলেছেন, তাদের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে না।
এর আগে গত বছর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ঠিক সামনেই চিশতিয়া হোটেলের ওপর টিনের ছাপড়া ঘরে হার্ডবোর্ডের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা একটি বেসরকারি ভুয়া ক্যানসার হাসপাতালের অস্তিত্ব পান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ডক্টরস চেম্বার নামক এ হাসপাতাল থেকে বিউটি ও শাহাদাত নামে দু’জনকে আটক করা হয়। ধরা পড়ার পর বিউটি র্যাবকে জানায়, তিনি নার্স হয়ে ডাক্তারের কাজ করতেন ও শাহাদাত হাসপাতালের ম্যানেজার। সেখানে চারটি কেবিনসহ ১৮টি বেড সাজিয়ে ‘ভয়াবহ পরিবেশে’ চলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের কেমোথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা। এ ঘটনার পর রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ভুয়া হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে হৈ চৈ পড়ে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিযানে হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা খুবই কম। গত প্রায় দু’বছর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাবর রোডের ১৬/১৪ নম্বর ছয়তলা ভবনের তিন তলায় ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশার সমন্বয়ে র্যাবের মোবাইল কোর্ট। এর পরই বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর এসব তথ্য। গভীর রাতে দেয়াল ফুটো করার ড্রিল মেশিন দিয়ে রোগীর অপারেশন করতেন এ হাসপাতালের মালিক পাইক বাবু ও অষ্টম শে্রিণ পাস ‘ডাক্তার’ রতন কৃষ্ণ। বাইরে সবুজ রঙের বিশাল সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা ছিল হাসপাতালের নামটি। তার নিচেই হলুদ রঙে লেখা ‘চিকিৎসাসেবায় একধাপ এগিয়ে’। এছাড়া সাইনবোর্ডে অর্থোসার্জারি, নিউরোসার্জারি, গাইনি, জেনারেল শিশু সার্জারি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের নাম রয়েছে। কিন্তু ভেতরে হাসপাতাল নয়, যেটি আছে সেটি কসাইখানা!
গেলো বছর র্যাব-৪ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল-আমীনের নেতৃত্বে রাজধানীসংলগ্ন ধামরাই ও আশুলিয়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একাধারে ভুয়া হাসপাতাল ও ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত করা হয়। ধামরাইয়ে মালেকা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১৩ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে সিলগালা করে দেয়া হয়।
রাজধানীর ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামলী, ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল, লক্ষ্মীবাজার জনসন পরাডের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক ও হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘিরেও রয়েছে অসংখ্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এগুলো গড়ে উঠে চাঁনখারপুল ও নাজিমউদ্দিন রোডে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে নিবন্ধিত ও বৈধ চিকিৎসা সেন্টারের সংখ্যা রয়েছে আট হাজার ৬২০। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ৬৬০। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, রাজধানীতে চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে এর কয়েকগুণ বেশি। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে রয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ নানা ক্লিনিক। এর একটি বড় অংশের নেই সরকারি অনুমোদন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অনুমোদন দেয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মহলের তদবির লেগে থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার থাকে না। প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক বা চিকিৎসক নেতাই বেশি তদবির করেন। আর এসব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বেশিরভাগেরই মালিক নামে বেনামে বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক। এছাড়া হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেলে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে সাময়িকভাবে ক্লিনিকের কার্যক্রম গুটিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিকরা এসবের তোয়াক্কা করে না। বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা শুরু করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়নও করা হয় না। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন তো আরো দূরের কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ এবং অভিযান চালানো হয় না। যে কারণে অবাধে অসাধু চক্র চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক ব্যবসা। আর এতে প্রতিনিয়তই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সহজ-সরল রোগী ও তার পরিবার প্রতারণার শিকার হচ্ছে এ শ্রেণির অসাধু ক্লিনিক মালিক, ভুয়া ডাক্তার ও দালাল চক্রের। দালাল চক্র এসব সহজ-সরল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকে তাদের নির্ধারিত ক্লিনিক ডায়াগনস্টিকের কথা। একজন রোগীকে তারা কোনোভাবে ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করতে পারলেই তারা পায় মোটা অঙ্কের কমিশন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। অতীতে চিন্তা ভাবনা না করেই অনেক মেডিকেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো সরকারি নীতিমালা মেনে চলছে কিনা দেখা হচ্ছে। যেসব মেডিকেল কলেজ সরকারি নীতিমালার আলোকে ব্যবস্থা নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া হবে। রাজনৈতিক কোনো চাপের কাছে আমি নতি শিকার করবো না। যে চারটি অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, উন্নতি না হলে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেব। সেখানে শিক্ষক আছে কিনা, লাইব্রেরি আছে কিনা, ল্যাবরেটরি আছে কিনা দেখা হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, ঢাকা শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো ডায়াগনিস্ট সেন্টার গড়ে উঠছে। পাড়া মহলায় যেভাবে ডায়াগনিস্ট সেন্টার গড়ে উঠছে দুনিয়ার কোথাও নাই। একটা সীমার মধ্যে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল হতে হবে। যত্রতত্রভাবে ডায়াগনিস্টিক সেন্টার হতে পারে না।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |