জীবনযাত্রাকে সহনীয় করতে ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্রদের চাল দেওয়ার উদ্যোগ যুগান্তকারী। দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হবে জেনেও এই কর্মসূচি চালু হয়েছে ৭ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামে চাল বিতরণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। পরে পর্যায়ক্রমে শুরু হয় সারা দেশে। অথচ বিতরণে অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগে সরকারের দরিদ্রবান্ধব এই কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।১০ টাকায় চাল! দুর্মূল্যের বাজার। কল্পনাতেই ছিল না কারো। সরকারের খাদ্যবান্ধব উদ্যোগ কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। ওদিকে মার্চ-এপ্রিল। এদিকে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। চালের দাম উঠতে থাকে। কম আয়ের মানুষের সংসার সারা বছরই কাটে অভাবে। এ সময়টায় এসে হোঁচট খায় নতুন করে।
চাল বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। কথা ছিল এই কমিটির হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ঠিক করে তাদের কার্ড দেবে। নীতিমালা অনুযায়ী তাদের চাল দেওয়া হবে। অভিযোগ উঠেছে দেশের কোনো জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। হয়েছে স্বজনপ্রীতি। ক্ষমতার প্রভাব খাটানো হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। এই চাল কালোবাজারে বিক্রিরও অভিযোগ উঠছে। এসব দায় যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর। অন্তহীন অভিযোগের তালিকায় আছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী মহল। অভিযোগ আছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। এ তালিকাতেও ঢুকে পড়েছেন দলীয় লোকজন। কার্ড পেতে জনপ্রতি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে কোনো কোনো এলাকায়। কোথাও ১০ টাকার চাল বিক্রি করা হচ্ছে তিনগুণ দামে। কোথাও আবার পুরো টাকা নিয়ে পরিমাণে চাল কম দেওয়া হচ্ছে। অনেক জায়গায় টাকা দিলেও চাল মিলছে না। ডিলারদের অজুহাত, চালের মজুদ শেষ।
প্রতিদিনই এসব অভিযোগ যখন আসতে শুরু করল সংবাদপত্রে, নড়েচড়ে বসল স্থানীয় প্রশাসন। তদন্তে গিয়ে সত্যতা মিলেছে অনেক অভিযোগের। ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন, প্রশাসনের এই তৎপরতা কার্ড বিতরণের সময় থেকে শুরু হলে কী ক্ষতি হতো? গরিবের হয়রানি কি কমত না? সরকারের মহৎ এই উদ্যোগের সুফল হতদরিদ্রদের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেত না? শুরুতে প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বিতর্কিত হয়েছে সরকারি দল, দলীয় নেতারা। সমালোচনামুখর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের বিরোধী রাজনৈতিক মহল।
গরিবের চাল নিয়ে চালবাজির দায় প্রশাসনের কর্তারা চাইলেই এড়াতে পারবেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের প্রশংসনীয় এই উদ্যোগ নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে এ জন্য দায়ী স্থানীয় প্রশাসন। তারা এখন যেভাবে কঠোর হচ্ছে, ব্যবস্থা নিচ্ছে শুরু থেকে এটা করলে এত অনিয়ম হতো না। অসচ্ছলদের চাল সচ্ছল লোকেরা পেতো না।
তবে তৃণমূল প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও আছে পাল্টা উত্তর। একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, স্থানীয় প্রশাসন অনেক কিছু করতে পারে এটা যেমন সত্যি, তেমনি আবার অনেক সময় উপায় থাকে না, এটাও ঠিক। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নানামুখী চাপে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক লোকদের মধ্যে কম টাকার চালের কার্ড বিতরণ করা যায়নি। প্রকৃত গরিবের পরিবর্তে দিতে হয়েছে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় নেতা-কর্মীদের। এখন অবশ্য বিষয়গুলো সংবাদপত্রে ওঠে আসায় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হচ্ছে।
সামাজিক কল্যাণমূলক এই কর্মসূচির শুরুতে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে বঞ্চিতের হার কমে এলেও প্রকৃত হতদরিদ্র অনেকেই এর সুফল পাবেন না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান এই সময়কে বলেন, ‘অনিয়মের মাধ্যমে তালিকা করে যারা কার্ড পেয়ে গেছেন তারা তো নিয়মিতই চাল পাবেন। সবক্ষেত্রে তাদের কার্ড তো বাতিল করা সম্ভব হচ্ছে না।’
আতিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারের উদ্যোগ ভালো। তবে আপাত ব্যর্থতার নেপথ্যে স্থানীয় প্রশাসন। তারা যদি শুরু থেকেই কঠোর থাকত তাহলে অস্বচ্ছতা থাকত না।’
অস্বচ্ছতার অভিযোগ এরই মধ্যে আমলে নিয়েছেন দরিদ্রবান্ধব এই কর্মসূচির প্রণেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খোদ জাতীয় সংসদে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি কেউ অনিয়ম করে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এখন অবশ্য ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি দুদকে পর্যন্ত যেতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এরই মধ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত খাদ্য কর্মকর্তা ও ডিলারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা দায়ের করা হবে।’
অস্বচ্ছতার যত চিত্র
ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের লোভ আটকে গেছে গরিবের চালে। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বাঁধাল ইউনিয়নে ঘটেছে এ কাণ্ড। খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পাওয়া অভিযোগের তালিকায় দেখা গেছে, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পরিবারের সদস্যরা ১০ টাকা কেজির চালের কার্ড পেয়েছেন। তারা চালও তুলেছেন। পরে এ নিয়ে অভিযোগ উঠলে উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় ১০ টাকার চাল পাওয়ার যোগ্যদের তালিকায় তুলে দেওয়া হয়েছে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম। পরে তদন্ত হয়েছে। প্রমাণ মিলেছে। আট ইউনিয়নের তালিকা থেকে ১২৫ জন সচ্ছল ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
যশোরের সদর উপজেলার ৮৭ হাজার ৪৬৬টি হতদরিদ্র পরিবারকে ১০ টাকার চাল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তালিকাও করা হয়নি। ১৫ অক্টোবর সংবাদপত্রে খবর এসেছে। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। তদন্তে অনিয়ম বেরিয়ে এলো কি না তা এখনো জানা যায়নি।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নে ১০ টাকার ১৮৩ বস্তা চাল জব্দ করা হয়। স্থানীয় ডিলার সেপ্টেম্বর মাসেই দ্বিতীয় কিস্তির চাল তুলে তালতলা বাজারে গোডাউনে রেখে দিয়েছিল। বিতরণ করেনি। এ ঘটনায় ১৯ অক্টোবর ছয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় ঘটেছে আরও নিন্দনীয় ঘটনা। মৃত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জায়গা দেওয়া হয়েছে কম টাকার চালের তালিকায়। বাদ পড়েছেন প্রকৃত দুস্থরা। আছে ডিলারদের বিরুদ্ধে চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগও। জবাবে উপজেলার খাদ্যনিয়ন্ত্রক নজর আলী বলেন, ‘অনিয়মের অভিযোগ লিখিত পাওয়া গেছে ব্যবস্থা নেব।’
জামালপুরের ইসলামপুরে চালের ডিলার হয়েছিলেন তিন শিক্ষক। তথ্য গোপন করেছিলেন। অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পর তিন শিক্ষকের ডিলারশিপ বাতিল হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সদরে ১০ টাকার চালের কার্ড দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ইউনিয়নে বিত্তশালী, প্রভাবশালী ও কলেজ শিক্ষকদের। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশও দিয়েছে।
ভোলার চরফ্যাশনের নীলকমল ইউনিয়নে গরিবের চালের তালিকায় উঠেছে মৃত ব্যক্তি, স্কুল শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী), শ্রমিক লীগ সভাপতিসহ ধনাঢ্যদের নাম। নীলকমল ইউনিয়নের সদস্য, ডিলারসহ ১০ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে অভিযোগ করেছে। পরে তালিকা সংশোধনের জন্য নির্দেশ দিয়েছে ইউএনও।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক বাজারে ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রিতে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে গেলে সত্যতা পায়। পরে মেসার্স সফি এন্টারপ্রাইজের মালিক আক্কাস মিয়াকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে দোকান সিলগালা করে দেয়।
বগুড়ার কাহালুতে দরিদ্রদের তালিকায় করা হয়েছে বড় ধরনের স্বজনপ্রীতি। তালিকায় ওঠে এসেছে অনেক সচ্ছল ব্যক্তির নাম। শুধু তাই নয়, চাল তুলে কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগও উঠেছে তৃণমূলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। পরে স্থানীয় ইউএনও ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাতিল করেছেন একজনের ডিলারশিপ।
কার্ড জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন জায়গায়। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় তালিকায় থাকার পরও ১৮টি গরিব পরিবারকে কার্ড দেওয়া হয়নি। চূড়ান্ত তালিকায় ওইসব পরিবারের নামে চাল তোলার পর ফ্লুইড দিয়ে নাম মুছে দিয়ে কার্ড বদলে দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা সুযোগে চালবাজি করছেন। সিলেট সদরে ডিলারের কাছ থেকে ১০ টাকা কেজির চাল কিনে গুদামবন্দি করেছেন ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮০ বস্তা চাল জব্দ করেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ আছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় গত ২২ অক্টোবর থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে চাল বিক্রি বন্ধ আছে। সবার কার্ড ফেরত নেওয়া হয়েছে। তদন্তের পর প্রকৃত দরিদ্রদের হাতে কার্ড ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে দরিদ্রের চাল নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আছে। ৯টি ইউনিয়নের অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সচ্ছল ও স্বজনদের মধ্যে কার্ড বিতরণ করেছেন। আলীনগর ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডে কোনো কার্ড বিতরণ করা হয়নি। স্থানীয় ইউএনও বলেছেন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
নীলফামারীর জলঢাকা ও কিশোরগঞ্জে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণে এখনো ডিলার নিয়োগ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গত ২৫ অক্টোবর জানান, গত ২৩ অক্টোবর ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। সেদিন কিছু লোক অনিয়মের অভিযোগ করে বিক্ষোভ করলে প্রক্রিয়াটি স্থগিত করা হয়।’
গত ১৭ অক্টোবর ১০ টাকা কেজি দরে চালের কার্ড বিতরণকে কেন্দ্র করে বগুড়ার আদমদীঘির চকবাড়িয়া গ্রামে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়। এ ঘটনায় দুলু খোরশেদসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তারকৃত দুলু ও খোরশেদ আলমকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদমদীঘির চাঁপাপুর ইউনিয়নের চকবাড়িয়া গ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জাহাঙ্গীর আলম ও দুলুর মধ্যে গ্রামে দীর্ঘদিন যাবৎ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল।