এবার আর রক্ষা নেই। ঢাকায় চট্টগ্রামের প্রতিশোধ । সাজঘরে মাথা নিচু অ্যালেস্টার কুকের। নখ কামড়াচ্ছিলেন ফিফটি করা বেন ডাকেট। হার নিশ্চিত। নবম ব্যাটসম্যানও সাজঘরে। ইংল্যান্ড শিবিরে শোকের ছায়া। গুটিকয়েক বার্মি আর্মির উল্লাস থেমে যায় আরও আগেই। ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশ শিবিরে। আনন্দ উল্লাসে মাতোয়ারা সবাই। অধীর আগ্রহে দু’দেশের সব চোখ যেন মিরপুরের মাঠে। ফিনের উইকেট পতনের পর মাঠের মধ্যে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের সেকি আনন্দ! শিশুর মতো কতক্ষণ লাফালেন তারা। মেহেদী হাসান মিরাজের বল ফিনের পায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই জোরালো আবেদন। আঙুল তোলার আগে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন আম্পায়ার ধর্মসেনা। আউট দেয়া আর না দেয়া নিয়ে রিভিউর মারপ্যাঁচে এ সিরিজে কী নাজেহালই না হলেন এ শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার। খানিক আগেই তার এক আউট রিভিউতে নাকচ হয়ে যায়। তবুও দ্বিধা করলেন না। কিন্তু স্টুয়ার্ড ফিন ফের রিভিউ চাইলেন। কপাল মন্দ। রিভিউয়ের কোটা শেষ। আর এটা জেনেই আনন্দে দৌড় শুরু মেহেদী-মুশফিক- সাকিবদের। ইংল্যান্ডের রান তখন ১৬৪। লক্ষ্য থেকে ১০৮ রান দূরে। অসাধারণ নাটকীয় এক টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। ক্রিকেটের অভিজাত আসরে ঐতিহাসিক জয় বাংলাদেশের। ক্রিকেটের জনকদের বিপক্ষে জয়। ১০ টেস্টে প্রথম। বড় কোনো দলের বিপক্ষেই প্রথম জয় এবং সিরিজ ড্র। ৯৩ টেস্টে বাংলাদেশের জয় ছিল সাত। আর এর পাঁচটিই ছিল ক্ষয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আর দুটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। যে জয়ে নিজেদেরই তৃপ্তি ছিল না। ৯৪তম টেস্টে এসে প্রথম বড় কোনো দলের বিপক্ষে জিতলো বাংলাদেশ। জয়টা হতে পারতো আগের টেস্টেই। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। কানের পাশ দিয়ে গুলি যায় ইংল্যান্ডের। অনেকটা অভিজ্ঞতার কাছে হার মানে বাংলাদেশ। মাত্র ২২ রানে জিতে ইংল্যান্ডও স্বীকার করে নিয়েছিল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। কিন্তু এবার আর হলো না। সবাই মানলেন এগিয়েছে বাংলাদেশ।
১০০ রানের ওপেনিং জুটির পর মাত্র এক সেশনেই ১০ উইকেটের পতন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ২২.৩ ওভারে ঘুরে গেল খেলার ভাগ্য। ইংল্যান্ড যখন ১০০/০-তে চা বিরতিতে যায় তখন বাংলাদেশ জুড়ে হতাশা। আর হলো না। এবার নিশ্চিত আরো বড় ব্যবধানে হার হচ্ছে বাংলাদেশের। বোদ্ধারাও পড়ে যান দ্বিধায়। মাত্র ১৩১ বলে ১০০ রান তুলে নির্ভার ইংল্যান্ড। প্রথমবারের মতো ঝলসে ওঠে ইংল্যান্ডের ওপেনিং জুটি। এশিয়ার মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে এর আগে মাত্র দুবার ১০০ রান তুলতে পেয়েছিল ইংল্যান্ড। আগের টেস্টে অভিষেক হওয়া বেন ডাকেট থোরাই কেয়ার করছিলেন বাংলাদেশের বোলারদের। ৬১ বলে প্রথম ফিফটি পূরণ করে নেন। ইংল্যান্ডের ধারাভাষ্যকারদের গলার জোরও যেন বেড়ে যায়। কে জানতো মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানেই উল্টে যাবে গণেশ। চা বিরতিতে চায়ের সঙ্গে কী যেন টা-ও পান করে আসেন বাংলাদেশের বোলাররা। প্রথম বলেই ডাকেটকে ফেরালেন ম্যাজিক বয় মিরাজ। কারও দয়ায় নয়, সরাসরি বোল্ড। তার পরের ওভারের প্রথম বলেই রুটকে বিদায় করেন সাকিব। এরপর কুক আর ব্যালেন্স খানিকটা প্রতিরোধ গড়ার আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বালির বাঁধের মতোই ভেসে গেলো। কুক থাকলেও অপর পাশ থেকে ব্যালান্সের পর মঈন আলীও আউট। বোলার সেই মিরাজই। নিজের চতুর্থ শিকার বানালেন তিনি কুককে। এরপর আগের টেস্টের সেরা খেলোয়াড় বেন স্টোকস মাটি আঁকড়ে থেকে নিজের দক্ষতা দেখালেন বটে কিন্তু তা দলের জন্য তেমন কাজে আসেনি। সাকিবের বলে বোল্ড হন তিনি। ডাকেট ৫৬, কুক ৫৯ আর স্টোকস ২৫ রান করেন। অন্য কেউ দু’অঙ্ক স্পর্শ করতে পারেননি। চারজন আউট হন শূন্যরানে। ১০ উইকেটের ছটি মিরাজ আর চারটি সাকিব। অভিষেকে দুই টেস্টের সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন মেহেদী হাসান। অভিষেকের দুই টেস্টের তিন ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয়ার কৃতিত্বও ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র চারজনের ছিল। আর তার অর্জনের পুরস্কারও পেয়েছেন এ অলরাউন্ডার ম্যাচসেরা আর সিরিজসেরা হয়ে। প্রথম ইনিংসে ৮০ রানে ৬ উইকেট নেয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৭ রানে ৬ উইকেট, ১৫৭ রানে ১২ উইকেট। এখন বাংলাদেশের কোনো বোলারের এক টেস্টে এটাই সেরা। এর আগে ২০০ রানে ১২ উইকেট নিয়ে শীর্ষে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক এনামুল হক জুনিয়র। সাকিব দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট নেন ৪৯ রানে। দুই টেস্টে তার অর্জন ১২ উইকেট। এর আগে গতকাল বাংলাদেশ দল ৩ উইকেটে ১৫২ রান নিয়ে খেলতে নেমে ২৯৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। সর্বোচ্চ ৭৮ রান করেন ইমরুল কায়েস। এছাড়া সাকিবের ৪১ আর শুভাগত হোমের অপরাজিত ২৫ ছিল উল্লেখ করার মতো। ইংল্যান্ডের স্পিনার আদিল রশিদ নেন ৪ উইকেট। ২৭৩ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায় ইংল্যান্ডের। ইতিহাস বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল। উপমহাদেশের মাটিতে এতো রান করে কখনও জিততে পারেনি ইংল্যান্ড।
বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিক ঢাকা টেস্ট শুরুর আগেই বলেছিলেন, চট্টগ্রামে যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকেই শুরু করতে চান। শেষ পর্যন্ত তার ৫০তম টেস্টে বাংলাদেশ পেলো ঐতিহাসিক জয়। ১৫ মাস পর টেস্ট খেলতে নেমে নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহানই ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজের ম্যাজিক, সাকিব আল হাসেনের চতুর ঘূর্ণি, তামিম-ইমরুলের দৃঢ়তাপূর্ণ ব্যাটিং বাংলাদেশকে এ জয়ের ভিত এনে দেয়। মাত্র ১০ দিন পর টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১৬ বছর পূর্তি। আর তার আগে ঐতিহাসিক এক মাইলফলক স্পর্শ করলো বাংলাদেশ। ২০০০ সালের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় টেস্ট সংখ্যা এখন নার্ভাস নাইনটিতে। টেস্ট খেলতে না পারার আক্ষেপ তাই ঝরে পড়লো বাংলাদেশ অধিনায়কের কণ্ঠে। তার আশাবাদ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বাংলাদেশকে বড় দেশগুলোর বিপক্ষে আরো বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ করে দেবে।
টেস্ট ক্রিকেটের যবনিকাপাতে যারা অগ্রণী থাকেন বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজ দেখার পর তারা নিশ্চয়ই চুপসে যাবেন। টেস্ট ক্রিকেটও যে এমন নাটকীয় হতে পারে, হতে পারে চরম উত্তেজনার, তার স্বাক্ষর দুই টেস্টের এ সিরিজ।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |