রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত এ বছরই শেষ হচ্ছে না । সবগুলো দিক শেষ করতে আরও কয়েকমাস সময় লেগে যাবে। যেহেতু এ ঘটনায় বাংলাদেশ ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেজন্য তদন্তে সময় লাগছে বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে তাদের দাবি, তদন্তের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এখন বিদেশি হ্যাকার ও জুয়াড়িদের নেপথ্যে কারা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজস কোথায় সে বিষয়টি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় চুরি, আইসিটি ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো তিন ধরনের অপরাধ তদন্ত করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট সিআইডি’র কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ছাড়াও আটটি দেশের নাগারিক রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত। দেশগুলো হচ্ছে ফিলিপাইন, হংকং, ম্যাকাও, চীন, শ্রীলংকা, মিশর, সিঙ্গাপুর ও জাপান। ওইসব দেশের যেসব নাগরিক এ ঘটনায় জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা লাগে। তাদের তৎপরতার ওপরও নির্ভর করছে তদন্ত কবে শেষ হবে।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট সিআইডি’র এক কর্মকর্তা আরও জানান, চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি করা হয়। তারা হলো- হ্যাকার, মানিলন্ডার, নেগোশিয়েটর ও ‘ইনসাইডার’। ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) কর্তৃপক্ষই মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। হ্যাকিংয়ের বিষয়টিও কয়েকদিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। হ্যাকারদের ম্যালওয়ারের মাধ্যমে আক্রান্ত ৩৫টি ডিভাইসও এরইমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে বসে পরিকল্পিতভাবে যারা হ্যাকারদের সার্ভারে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিয়েছিল সেই ইনসাইডার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত: ২০ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সংশ্লিষ্টতার অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তারা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য দেশের সব বিমান, স্থল ও নৌ বন্দরগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। তাদের চলাচল ও গতিবিধির ওপরও নজরদারি রাখা হয়েছে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনার মামলার তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হচ্ছে জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কমান্ডেন্ট ও মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত এগুচ্ছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এ ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ জড়িত।’ তিনি আরও বলেন, ‘তদন্তটা যদি আজকেও শেষ করা যেত, তারপরও আমার আরও তিন-চার মাস সময় লাগবে চার্জশিট দিতে। কারণ, তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া তথ্য-প্রমাণগুলো নিশ্চিত করতেও কয়েক মাস সময় লাগবে। কম করে হলেও তিন মাস।
তিনি বলেন, এ মামলার তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের উদ্যোগে গত ৪ অক্টোবর থেকে ৬ অক্টোবর আমরা সিঙ্গাপুরে বসেছিলাম একটা কো অর্ডিনেশন মিটিংয়ে। সেখানে আমি ছাড়াও বাংলাদেশের আরও তিন প্রতিনিধি গিয়েছিলেন আর মিটিংয়ে আটটা দেশের ২৫জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমেও কয়েকটি দেশ আমাদের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছে। ওই বৈঠকে অনেক বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে তদন্ত কীভাবে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া যায় সেই বিষয়টি বৈঠকে অগ্রাধিকার পেয়েছে।
রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে আদালতের নির্দেশনা আছে কিনা জানতে চাইলে সিআইডির কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, এ নিয়ে একটা বিভ্রান্তি হয় মাঝে মাঝে। যেকোনও মামলা হলেই আদালত কয়েকদিন পরপর তারিখ দেন শুনানির জন্য। তবে যেভাবে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায় সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু ঘটনাস্থল যখন দেশের বাউন্ডারি পেরিয়ে কয়েকটা দেশে চলে যায়, তখন আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি ওই দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার ওপর। ওই দেশের একজনকে আমরা পেলেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবো না। সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়েই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সেজন্য কাজের ক্ষেত্রে একটু চাপতো পড়েই।
সিআইডি ছাড়াও রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পুলিশ সদর দফতর, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। সবগুলো বিভাগের একটি সমন্বিত টিম এ তদন্ত কাজ চালাচ্ছে। অর্থ চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান।