দক্ষিণ এশিয়ার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিমালয় কন্যা নেপালে দ্রুতগতিতে বাড়ছে অপরাধ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু অপরাধের শহর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সেদেশের গণমাধ্যমেই। ক্রমবর্ধমান অপরাধের ঝুঁকিতে আছে নেপালের আরও ৯টি জেলা।
বাংলাদেশের মতো নানামুখী অপরাধের মধ্যে নেপালে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ (সাইবার ক্রাইম)।
পর্যটকনির্ভর অর্থনীতির দেশটিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে পর্যটন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছে সেদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম।
সম্প্রতি দেশটিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বছরওয়ারী একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে নেপাল পুলিশ।
সেই পরিসংখ্যনের উপর ভিত্তি করে ২০ অক্টোবর নেপালের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্যা হিমালয়ান লিখেছে, নেপালে বছরে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে অপরাধ বাড়ছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, ২০১৪-২০১৫ বছরে নেপালে ২৮ হাজার ৭০টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করেছে পুলিশ। ২০১৫-২০১৬ বছরে সেটি ২৮ হাজার ৫৬৩টি অপরাধ হয়েছে বলে পুলিশ নিজেই তথ্য দিয়েছে সেদেশের গণমাধ্যমে।
নেপাল পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫০ লাখ জনসংখ্যার কাঠমান্ডুতে ২০১৫-২০১৬ বছরে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯১৭টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অর্ধেক সাইবার ক্রাইমের ঘটনা।
কাঠমান্ডুর পরেই আছে সুনসরি জেলা। সেখানে গত এক বছরে অপরাধ হয়েছে ১ হাজার ৪৪১টি।
এছাড়া গত এক বছরে চিতাবন জেলায় ১ হাজার ২৪১টি, ঝাপা জেলায় ১ হাজার ১৯৬টি, রূপন্দেহী জেলায় ১ হাজার ১৭৯টি, কাচকি জেলায় ৯৫৮টি, মোরঙ জেলায় ৯৪৫টি, ললিতপুর জেলায় ৯০২টি, বাঁকে জেলায় ৭৪৪টি এবং পর্সা জেলায় ৭০৬টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করেছে পুলিশ।
নেপালের মোট ৭৫টি জেলার মধ্যে ৯টি জেলায় অপরাধ তুলনামূলক কম হয়েছে বলে জানিয়েছে সেদেশের পুলিশ বিভাগ।
জেলাগুলোর মধ্যে মানাংয়ে ১১টি, হামলেতে ১৪টি, মুগুতে ৩৫টি, দোলপাতে ৩৮টি, রসুয়াতে ৪৫টি, দরচুলাতে ৫০টি, বাজুরাতে ৬০টি, দতিতে ৬৩টি এবং ডডেলধুরায় ৬৬টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করেছে পুলিশ।
নেপালের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্যা হিমালয়ান জানিয়েছে, নেপালে সাধারণত ১৩ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটে। এগুলো হচ্ছে খুন ও খুনের চেষ্টা, জালিয়াতি, মানব পাচার, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা, অপহরণ, মাদক চোরাচালান, দস্যুতা, অস্ত্র কেনাবেচা, চুরি, সাইবার ক্রাইম এবং বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ।
পত্রিকাটি লিখেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধের ঘটনা এমনভাবে বেড়েছে যা নেপালের নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী যারা ইন্টারেনট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত তাদের জন্য সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ করা এখন সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নেপালের কেন্দ্রীয় পুলিশের মুখপাত্র ডিআইজি হেমন্ত মল্ল ঠাকুরি ক্রমবর্ধমান অপরাধের জন্য পুলিশে জনবল সংকটকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
নেপালের বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ডিআইজি হেমন্ত মল্ল ঠাকুরি বলেছেন, নেপালে প্রতি ৫৬০ জনে মাত্র একজন পুলিশ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ১ হাজার ৯৩২ জনে মাত্র একজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছে।
‘কাঠমান্ডুতে বসবাসরত লোকের চেয়ে ভাসমান লোকের সংখ্যা আড়াইগুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এখানে অপরাধের হার ছোট শহর এবং গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বেশি। দ্রুত শহরায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটা প্রভাবও আছে। ’ বলেন ডিআইজি হেমন্ত।
ভাসমান লোকের শহরে প্রবেশের বিষয়টি দেখা গেছে কাঠমান্ডু শহরে। অফিস শুরুর আগেভাগে কিংবা ছুটির পর কাঠমান্ডু শহরের যে কোন সড়কে চোখে পড়বে যেন মোটরসাইকেলের মিছিল। শত, শত মোটরসাইকেল ছুটছে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।
দ্যা হিমালয়ানের নিউজ সার্ভিসের মতে, গ্রামাঞ্চল থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে লোকজন শহরে আসে আবার চলে যায়। এর ফাঁকেই ভাসমান লোকজন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
পাবলিক-পুলিশ পার্টনারশিপ, জনগণকে অপরাধ ও আত্মরক্ষা সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রমাণ নির্ভর তদন্তের মাধ্যমে নেপালের জনগণের জানমাল রক্ষা সম্ভব বলেও পথ বাতলে দিয়েছেন ডিআইজি হেমন্ত মল্ল ঠাকুরি।
নেপালের ছোট-বড় যে কোন শহরে গেলে চোখে পড়বে ছোট ছোট বিলবোর্ড যেখানে লেখা আছে ‘পুলিশ জনগণের সাথী’। এই প্রচারণা জানান দেয় নেপালের পুলিশ আর জনগণের হৃদ্যতার কথা।
কাঠমান্ডুর থামেল এলাকার ভাইসালি হোটেলের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, নেপালের পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবসময় সচেষ্ট। বিশেষত পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন আপোষ নেই। তবে তাদের কৌশল বোধহয় পাল্টাতে হবে। কারণ অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে।
কাঠমান্ডু শহরে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আনাগোণা থাকে বছরজুড়েই। পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুলিশের সক্রিয়তা দেখা গেছে শুধু কাঠমান্ডু নয়, এর থেকে ২২০ কিলোমিটার দূরের পোখারা শহরেও।
প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে সন্দেহজনক মোটরসাইকেল তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। নেপালের নাগরিকদের কেউ মাদক গ্রহণ করেছে কিনা সেটিও পরীক্ষা করা হয়। আর রাত ১২টার মধ্যে সব বিনোদন স্পট বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
তবে পর্যটকদের জন্য কোন বিড়ম্বনা নেই। শুধুমাত্র নেপালের রূপসৌন্দর্য দর্শনে যাওয়া পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতেই রাতের শহরে এত তোড়জোড়, বলেছেন থামেলে রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কয়েকজন।