অভিযোগের অন্ত নেই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে । এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, দলীয় নেতা সবাই এ কর্মসূচির অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার এসব অভিযোগ তদন্তও করছে। দায়ীদের শনাক্ত করলেও অনিয়মের কোনও সুরাহা হচ্ছে না।অনিয়মের তুলনায় শাস্তি কম হওয়ায় এ কর্মসূচি বা সরকারের সফলতা আলোর মুখ দেখছে না বলে মনে করেন অনেকেই।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কেউ অনিয়ম কিংবা বিতর্কিত করার চেষ্টা করলে ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তারপরও থেমে নেই অনিয়ম।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির বেশিরভাগ অভিযোগই ডিলারদের বিরুদ্ধে। হতদরিদ্রের তালিকা তৈরি করা থেকে চাল বিক্রির প্রতিটি পর্যায়েই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের করা তালিকায় হতদরিদ্র হিসেবে যারা নাম উঠাতে পেরেছেন, তাদের অনেকে চাল পাননি। যারাও বা চাল পেয়েছেন, তাদের নাম ওই তালিকায় উঠাতে বা চাল পাওয়ার জন্য ডিলারদের ঘুষ দিতে হয়েছে। কোনও কোনও স্থানে হতদরিদ্রের পরিবর্তে তালিকায় অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম দেওয়া হয়েছে। অনেক তালিকায় চাল আত্মসাতের উদ্দেশ্যে মৃত ব্যক্তির নামও স্থান পেয়েছে। তালিকায় ডিলার, চেয়ারম্যান, মেম্বার, আওয়ামী লীগ নেতার আত্মীয় স্বজনসহ কাছের লোকজনের নাম স্থান পেয়েছে। অনেক ডিলার কালোবাজারে বেশি দামে এই কর্মসূচির চাল বিক্রি করেছেন। তালিকায় এক ব্যক্তির নাম একাধিকবার এবং একই পরিবারের একাধিক লোকের নাম উঠেছে।
৩০ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও ওজনে কম দেওয়া হয়েছে। শহরের রাজনৈতিক নেতারা প্রভাব খাটিয়ে গ্রামে তাদের কাছের লোকদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট গুদামে চাল রাখার কথা থাকলেও যেন কেউ চালের হদিস না পায়, সেজন্য ডিলাররা এখানে-সেখানে চাল রেখেছেন। ডিজিটাল পদ্ধতির পরিবর্তে অনেক স্থানে বালতিতে অনুমান করে চাল দেওয়া হয়েছে। সরকারি দলের অন্তর্কোন্দলের কারণে হতদরিদ্রের তালিকা বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ছিল। অনেক সুবিধাভোগী এ চাল নিজে না খেয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার পর্যন্ত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় কেজি প্রতি ১০ টাকা দামের চাল বিক্রিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শরীয়তপুর সদর, গোপলগঞ্জের কোটালীপাড়া, মুকসুদপুর, নেত্রকোনার কলমাকান্দা, জামালপুর সদর, দেওয়ানগঞ্জ, নান্দাইল, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, বরিশালের গৌরনদী, কুমিল্লার তিতাস, ঝালকাঠির নলছিটি, দিনাজপুরের বিরল, রাজশাহীর গোদাগাড়ি, পটুয়াখালীর বাউফল, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, পাবনার চাটমহরের ৪৮ জনের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি অনিয়মের অভিযোগে করা ১১টি ফৌজদারি মামলায় ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২২ আসামির অন্যরা পলাতক রয়েছে। ওজনে কম দেওয়ায় ৯ ডিলারকে জরিমানা ও অভিযুক্ত খাদ্য কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। কর্মসূচিতে অনিয়মের জন্য নালিতাবাড়ী ও নান্দাইল উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং কালোবাজারিতে সহায়তার অভিযোগে সরিষাবাড়ি ও মেলান্দহ গুদামের (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে কেউ অনিয়ম করলে কিংবা বিতর্কিত করার চেষ্টা করলে কোনও ছাড় নেই।’
তিনি বলেন, ‘এটি হত দরিদ্রদের কর্মসূচি। এটা বিতর্কিত করা যাবে না। কেউ করলে ছাড় পাবেন না। এ কর্মসূচি দলীয়করণ করতে দেবো না। তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিয়ম হয়েছে। কার্ড পাওয়ার জন্য যোগ্য না হয়েও অনেকে কার্ড পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কার্ড জমা দেওয়ার হিড়িকও পড়েছে।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অনিয়মকারী যে দলেরই হোক, তারা পার পাবেন না। এ কর্মসূচি মনিটর করতে সব জেলার ডিসিদের কাছে চিঠি দিয়েছি। এছাড়া, মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আট বিভাগে ৮টি তদন্ত টিম দেশব্যাপী চষে বেড়াচ্ছে। আট বিভাগের কমিশনারদের কাছেও এ কর্মসূচির চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। দেশের সব উপজেলায় এ কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচি শুরুর এক মাস পার না হতেই অনিয়মের হাজারও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবার ১০ টাকা কেজিতে প্রতি মাসে ৩০ কজি করে চাল পাবে। এই কর্মসূচি চলবে প্রতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এ পাঁচ মাস।