স্কুল শিক্ষিকা আতিয়া জাহান মৌ ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বে খুন হন। নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন ঝুমুর নামের কথিত এক মক্ষিরানী। গত বছরের ৬ই নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বত্রিশ এলাকায় নিজেদের বাসার দ্বিতীয় তলায় খুন হন আতিয়া জাহান মৌ (২২)। স্কুল শিক্ষিকা আতিয়া জাহান মৌ মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের সৌদি প্রবাসী কামাল হোসেনের মেয়ে এবং গোপদিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১১ মাস পর সিআইডির তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে এর নেপথ্য কাহিনী। তিন প্রেমিক, এক সহযোগী এবং কথিত মক্ষিরানী ঝুমুরসহ এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত ৬ই অক্টোবর আদালতে দাখিল করা হয়েছে মামলার চার্জশিট। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক মো. শহীদুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে উল্লেখিত পাঁচ আসামির মধ্যে দুই প্রেমিক রাজীব (২৫) ও টিটু (২৪) এবং মক্ষিরানী ঝুমুর (৪৪) পলাতক রয়েছে। বাকি দুই আসামির মধ্যে অপর প্রেমিক ইউসুফ হায়দার রিফাত (২৪) এবং সহযোগী অসীম কুমার দেব (২৪) জামিনে রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজীব শহরের বিলপাড়া এলাকার আবদুল করিমের ছেলে, টিটু শহরের বত্রিশ কসাই বাড়ি রোডের ইসলাম শেখের ছেলে, ইউসুফ হায়দার রিফাত মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের নাছির উদ্দিন হারুনের ছেলে, অসীম কুমার দেব ইটনার অনাদী দেবের ছেলে এবং ঝুমুর শহরের বত্রিশ মুক্তি স্মরণী রোডের প্রবাসী আলমগীর হোসেনের স্ত্রী।
সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক মো. শহীদুল ইসলাম খান জানান, অভিযুক্ত ঝুমুর শহরে মক্ষিরানী হিসেবে পরিচিত। তার স্বামী আলমগীর হোসেন দেশের বাইরে থাকেন। ঝুমুর উচ্ছৃংখল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সে কৌশলে সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। পরবর্তী সময়ে অভিজাত দুশ্চরিত্রদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে শয্যাসঙ্গী করে দেয়। শিক্ষিকা মৌ-এর প্রতিবেশী হিসেবে ঝুমুর সহজেই তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে। কৌশলে তাকে বিভিন্ন অভিজাত খদ্দেরদের কাছে নিয়ে গেলেও মৌকে অনৈতিক কাজে নামাতে পারেনি। একপর্যায়ে মৌকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম করে রাজধানী ঢাকার তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তার গাড়িতে তুলে কৌশলে যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবন করায়। পরে গাড়ি নিয়ে নেত্রকোনার কেন্দুয়া এলাকায় নিয়ে গেলে প্রেমিক ইউসুফ হায়দার রিফাত বিষয়টি জানতে পারে। এতে করে প্রেমিক রিফাতের সঙ্গে মৌয়ের দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রিফাত ভুল বুঝতে পেরে মৌ-এর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক গড়ে তোলে। দু’জনের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়ার বিষয়টি ঝুমুর সহজে মেনে নিতে পারেনি। এদিকে কথিত দুই প্রেমিকের মধ্যে টিটু এলাকায় নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। এসব অপকর্মে রাজীব ও অসীম ছিল তার সহযোগী। তবে রাজীব ও টিটু দু’জনেরই আকর্ষণ ছিল মৌ-এর প্রতি। পৃথকভাবে তারা মৌকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু মৌ তাতে পাত্তা দেয়নি। এর জের ধরে মৌ-এর প্রেমিক হিসেবে রিফাতকে কথিত প্রেমিক রাজীব মারধর করে। এছাড়া আরেক কথিত প্রেমিক টিটুকে মৌ প্রকাশ্যে জুতাপেটা করে। এ নিয়ে রাজীব ও টিটু মৌ-এর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। অন্যদিকে মৌকে বাগে আনতে না পেরে কৌশলে অপর দুই কথিত প্রেমিক রাজীব ও টিটুর সঙ্গে মক্ষিরানী ঝুমুর হাত মেলায়। এ সময় মৌ-এর বিরুদ্ধে তার কথিত দুই প্রেমিককে সে উস্কে দেয়। ফলশ্রুতিতে ত্রিভুজ প্রেমের এই দ্বন্দ্বের জের ধরে শিক্ষিকা আতিয়া জাহান মৌ খুন হন। কিন্তু হত্যার এই ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ঘাতকেরা মৌ-এর লাশ ড্রইং রুমের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখে। সিআইডির এই পরিদর্শক জানান, আসামি ইউসুফ হায়দার রিফাত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে জানায়, ঘটনার রাতে সে মৌ-এর ঘরে ছিল। মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় রাজীব ও টিটু ঘরে ঢুকে তাকে চড়-থাপ্পড় মারলে সে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঝুমুরকে গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু রিফাত পুলিশকে বা মৌ-এর স্বজনদের কাউকে বিষয়টি জানায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্কুল শিক্ষিকা আতিয়া জাহান মৌ ছুটির দিনে তার মা কবিতা আক্তারের সঙ্গে জেলা শহরের বত্রিশ মুক্তি সরণি রোডের বাসায় এসে থাকতো। নিজেদের ওই বাসার দ্বিতীয় তলার কক্ষেই গত বছরের ৬ই নভেম্বর রাতে খুন হন মৌ। ওই রাতে বাসায় মৌ ছাড়া পরিবারের অন্য কেউ ছিলেন না। ঘাতকেরা হত্যার পর লাশ ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মৌ যে কক্ষে থাকতেন, সেটিসহ পাশের একটি কক্ষের সব আসবাবপত্র ছড়ানো ছিটানো ছিল। তার মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়নি। ঘরের সব চেয়ার টেবিল নিচেই ছিল। তাছাড়া মৌ-এর কক্ষটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। পরে তালা ভেঙে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে থাকা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ৭ই নভেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মৌ-এর মা রওশন আরা কবিতা বাদী হয়ে রাজীব, টিটু ও রিফাতের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২৯শে নভেম্বর মামলাটির তদন্তভার সিআইডির কাছে ন্যস্ত করা হয়। গত ৩রা ফেব্রুয়ারি মামলার এফআইআরভুক্ত আসামি মৌ-এর কথিত প্রেমিক ইউসুফ হায়দার রিফাতকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। সে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে সহযোগী অসীম কুমার দেবকেও আটক করা হয়। বর্তমানে এরা দু’জনই জামিনে রয়েছে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031