লাখো হিন্দু পণ্ডিত ১৯৯০ সালের জঙ্গিবাদের বিস্তৃতির কারণে কাশ্মির ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন । ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে থাকে, কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িত সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের কারণেই ভিটেমাটি ছেড়েছিলেন ওই পণ্ডিতেরা। এবার সেই হিজবুল মুজাহিদিনই কাশ্মিরে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন সেখানকার নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকা হিন্দু পণ্ডিতদের। একটু দূরের জম্মু কিংবা অন্য কোনও দেশের উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাতে থাকা এই পণ্ডিতদের সুরক্ষা নিশ্চিতের অঙ্গীকারও করেছে সংগঠনটির নতুন কমান্ডার জাকির রশিদ ভাট ওরফে ‘মুসা’।
এই পণ্ডিতেরা হলেন কাশ্মিরের আদি উত্তরসূরী। কয়েক হাজার বছর ধরে ওই উপত্যকায় তাদের স্থায়ী বসবাস। ১৯৮৯ সালে কাশ্মিরের প্রথম অস্থিরতা এবং ৯০ এর জঙ্গিবাদ বিস্তৃতির বলি হন এইসব পণ্ডিতেরা। তাদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা-প্রতিক আকারে চিহ্নিত করে জঙ্গিরা অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড শুরু করে। অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রিমেইন সাইল্যান্সড নামের এক তথ্যচিত্রে এর নির্মাতা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অশোক পণ্ডিত দেখিয়েছেন, কাশ্মিরের জঙ্গি সংগঠনের তরফ থেকে এইসব পণ্ডিতদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয়।
তবে গতকাল মঙ্গলবার এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানি তাদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘আমরা কাশ্মিরি পণ্ডিতদের ঘরে ফেরার আবেদন জানাচ্ছি। তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’
কাশ্মিরের পণ্ডিতদের স্থানীয় সংগঠন এক জরিপের ভিত্তিতে জানিয়েছিল, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞের বলি হয়েছেন ৩৯৯ জন কাশ্মিরি পণ্ডিত। জুলাইয়ে প্রকাশিত পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন নিউজের এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত কাশ্মির ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৭ থেকে ৮ লাখ পণ্ডিত। ওদিকে অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রিমেইন সাইল্যান্সড নামের এক তথ্যচিত্রে দেখা যায়, ইয়াসিন মালিক (ফারুক আহমেদ দার) নামের একজন জঙ্গি গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন। শান্ত গলায় সে দাবী জানাল সে বিশ জনকে মেরেছে – আর তার জন্য সে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ফাঁসির সাজা আশা করছে। শেষ খবর অনুযায়ী ২০০৬ সালে ছাড়া পাওয়া ফারুক এখন রয়েছেন কাশ্মিরে। একইভাবে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে একইভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন ইয়াসিন মালিকও।
তবে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকলেও মঙ্গলবারের ভিডিওতে হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করে হিজবুল মুজাহিদিন। ভিডিও-বার্তায় কমান্ডার মুসা দাবি করেন, মুসলিমদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পরিপূর্ণ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তার দাবি, পাঞ্জাবের ‘অপারেশন ব্লু স্টারে’র কায়দায় কাশ্মির উপত্যকায়ও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। ওই অপারেশন থেকে পণ্ডিতদের বাঁচাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ভিডিওতে শিখ-বন্ধুদের নিয়ে আলাদা ইউনিট গড়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
উল্লেখ্য,৮ জুলাই অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হন। বুরহান নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে কাশ্মির জুড়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিক্ষুব্ধ কাশ্মিরিদের দাবি, বুরহানকে ‘ভুয়া এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে পুলওয়ামা ও শ্রীনগরের কিছু অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তীতে বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ধারাবাহিক খবর থেকে জানা যায়, পাঠানকোটের সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা এবং পরবর্তীতে হিজবুল নেতা বুরহান ওয়ানিকে কথিত এনকাউন্টারে হত্যার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পাঠানকোটের জঙ্গি হামলায় ‘পাকিস্তানি মদদপুষ্ট’ জঙ্গি সংগঠন জয়েশ ই মোহাম্মদ হামলা চালিয়েছে উল্লেখ করে ইসলামাবাদকে দায়ী করে ভারত। বিপরীতে পাকিস্তান কাশ্মিরের মানবাধিকার হরণের প্রসঙ্গ নিয়ে সরব হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সাম্প্রতিক উরি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার পর আবারও জয়েশ ই মোহাম্মদের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ তুলে পাকিস্তানকে দায়ী করতে শুরু করে ভারত।
পারস্পরিক দোষারোপ এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক তৎপরতার এক পর্যায়ে ২৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের সেনারা সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানোর দাবি করে। ঘটনাকে ভারতের দিক থেকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ প্রমাণ করে তাদের সামরিক শক্তি জানান দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবিটি একটি ভ্রম। মিথ্যে প্রভাব তৈরির জন্য ভারতীয়রা ইচ্ছে করে এমনটা করছে। দুই দেশ তাদের স্বদেশীয় সংবাদমাধ্যম এবং কূটনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে যার যার মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য।
এদিকে গোয়েন্দা আর বিশ্লেষকদের আশঙ্কার যথার্থতা প্রমাণ করে কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর ৫দিনে ২ বার ভারতীয় সেনাঘাঁটি আক্রান্ত হয়েছে। কাশ্মিরে বুরহানের হত্যাকণ্ডের পর থেকে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়েছে।