সরকার উচ্চ সুদে চীন থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে যাচ্ছে । এই ঋণ দেশের উন্নয়নে ব্যয় হবে। তবে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, চীনের এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের বিপদ বাড়তে পারে। কারণ, চীন থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে সার্ভিস চার্জসহ ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ হারে। পাশাপাশি প্রকল্পের যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য পণ্য চীন থেকেই আমদানি করতে হবে। এছাড়া চুক্তি কার্যকরের এক মাসের মাথায় পরিশোধ করতে হবে চুক্তির ব্যবস্থাপনা ও প্রতিশ্রুতি ফিও। এ অবস্থায় ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি যথাসময়ে প্রকল্পগুলো শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় থাকবে। এতে করে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ারও আশঙ্কা থাকবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বুধবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সব চুক্তি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের বাণিজ্যে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যেমন বাণিজ্য ঘাটতি আছে, ঠিক তেমনই থাকবে। বরং বৈদেশিক ঋণের বোঝা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে এমন কোনও চুক্তিতে যাওয়া উচিত হবে না, যাতে আমাদের বিপদ বাড়ে। আমাদের যেন ১০ টাকার জিনিস ২০ টাকায় গোছিয়ে না দেয়, সে ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তা না হলে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে সুস্পষ্টভাবে আমাদের চুক্তিতে যাওয়া উচিত।’

পিআরআই-এর এই গবেষক মনে করেন, ‘কেবল সরকারি আমলাদের ওপর ছেড়ে দিলে এর উপকারিতা পাওয়া যাবে না। বরং ঋণের বোঝা চাপবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।’ এ কারণে প্রত্যেক প্রকল্পের জন্য আলাদা-আলাদা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে তাদের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে চুক্তিতে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তার মতে, ‘প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য কারিগরি ও আর্থিক বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার পর চুক্তি করা উচিত। চুক্তি করার ক্ষেত্রে কেবল সাবধান বা সর্তক হলেই চলবে না, আমাদের সেই ধরনের প্রস্তুতিও থাকতে হবে। চুক্তি করলে আমাদের কতটুকু লাভ হবে, কতটুকু ক্ষতি হবে, কতটাকা খরচ হবে, কত বছরে প্রকল্প শেষ হবে, সব জেনে তারপর চুক্তিতে যাওয়া উচিত।’

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানে সমঝোতা স্মারক সই করেছে চীন। এর আওতায় ঢাকা-সিলেট চার লেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে।

জানা গেছে, সরকারি পর্যায়ে তিনটি বড় প্রকল্পে অর্থায়নে ৫টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে চীন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২ শতাংশ সুদের হার। সার্ভিস চার্জসহ পরিশোধ করতে হবে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা ফি ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়েছে ২০ বছর (৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ)। এছাড়া চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ফি পুরোটা পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

গত শুক্রবার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তার ২২ ঘণ্টার সফরে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। এর আওতায় ৩৪ প্রকল্পে ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন (দুই হাজার ৪৪৫ কোটি) ডলার ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে চীনের, যার বড় অংশই ব্যবহার করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের ঘোষণা বা আশ্বাস কখনও আসেনি। জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রদেয় চীনের এইসব ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ঠিকাদার হবে চীনের প্রতিষ্ঠান। দরপত্র ছাড়াই নিয়োগ দিতে হবে এসব ঠিকাদার। ফলে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারিত হবে পারস্পরিক দর কষাকষির মাধ্যমে। এতে  প্রকল্প ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা থাকছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্প ব্যয় যদি বাস্তবের তুলনায় বেড়ে যায়, তাহলে ঋণের বোঝা বাড়ার আশঙ্কা থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান ঋণ দিচ্ছে দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ হারে। তাদের তুলনায় চীনের ঋণের সুদের হার বেশি। এছাড়া চীনের প্রকল্পগুলোতে কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, দরপত্র আহ্বান, পণ্য কেনাকাটা সবকিছু চীন থেকে যদি আনা হয়, তাহলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। আর সেটা হলে আমাদের জন্য উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও জাইকাসহ বিভিন্ন সংস্থা এ পর্যন্ত আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে রয়েছে। অথচ এগুলো এখনও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। দেশে অবকাঠামো দুর্বলতা দুর না হওয়ায় এই অর্থ আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এ কারণে অবকাঠামো দুর্বলতা দূর না করে চুক্তি করা হলে ঋণের বোঝা বাড়ার আশঙ্কা থাকবে।’

জানা গেছে, চীনের ঋণে এরই মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প। ২০১৩ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইকালে এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের সময় এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। একই অবস্থা ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পেও। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে চার লেন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এখন এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীনের ঋণ গুণগত মানসম্পন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ ব্যবহার করা হলে তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়াবে। এর ফলে সরকারের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতাও বাড়বে। তবে অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কঠিন শর্তের এ ঋণ ব্যবহার করা হলে, সরকারের ঋণের বোঝা বাড়াবে।’

জানা গেছে, চীনের প্রেসিডেন্টের সফরকালে সরকারি পর্যায়ে ২৭টি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৩টি চুক্তি সই হয়েছে। বেসরকারিভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ১৩টি ও চীনের ৭টি প্রতিষ্ঠান চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সংক্রান্ত ২৭টি প্রকল্প রয়েছে। এ খাতে চীনের মোট সহায়তা হচ্ছে এক হাজার ৯৮০ কোটি মার্কিন ডলার। দু’দেশের সরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা প্রকল্পগুলো হচ্ছে—অবকাঠামো, সড়ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অবকাঠামো নির্মাণে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে চীন। পাশাপাশি রফতানি খাতে ১৮ কোটি ৬০ ডলারের চুক্তি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীনের এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা আমাদের নেই। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামো প্রস্তুত করা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণ নিয়ে যে সব প্রকল্প চালু করা হয়, তা যদি যথাসময়ে শেষ না হয় এবং বেসরকারি খাত যদি এই সব প্রকল্প থেকে উপকার না পায়, তাহলে এই ঋণ মাথাব্যথার কারণ বা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে প্রকল্প সময়মতো শেষ হওয়া জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণের এইসব প্রকল্পে উপকার পেতে হলে সুদের হার কম রাখার পাশাপাশি রি-প্রেমেন্ট পিরিওড ও গ্রেস পিরিওড দীর্ঘ রাখার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’

শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) সমঝোতা স্মারক ছাড়াও তিন প্রকল্পে সরাসরি ঋণচুক্তি সই করেছে চীন। এর মধ্যে ছয়টি জাহাজ কেনায় ১৮ কোটি ৪০ লাখ ও দাশেরকান্দিতে পানি শোধনাগার নির্মাণে ২৮ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হবে। এ প্রকল্প দুটির ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর বাইরে পায়রা বন্দরের কাছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৯০ কোটি ডলার ঋণ দেবে চীন। এ ঋণ ছাড়াও তিন প্রকল্পে ৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেবে চীন।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার। চীনের ঋণ যুক্ত হলে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়বে প্রায় ৬৬ শতাংশ।

জানা গেছে, সরকারি পর্যায়ে যে ২৭টি চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে তিন প্রকল্পের শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সমঝোতা চুক্তির আওতায় ২৮টি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনও শর্ত নির্ধারণ করা হয়নি। পরে চীনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শর্ত ও সুদ হার নির্ধারণ করা হবে।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতার অভাব তো আছেই। যথা সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে অধিকাংশ প্রকল্পই জটিলতায় পড়েছে। তবে চীনের এই ঋণ খরচের ক্ষেত্রে বড় কোনও সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’  তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যে তিক্ততার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এরপর সরকার অনেক সচেতন। এ কারণে চীনের এই ঋণ সহায়তা সঠিকভাবে ব্যবহার হবে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031