অনেক ইস্যুতেই ডনাল্ড ট্রাম্প আর ভ্লাদিমির পুতিনের অবস্থান এক। তবে একটি ইস্যুতে তারা দৃশ্যত বিপরীত মেরুতে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প যেখানে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো সামর্থ্যবান নন হিলারি ক্লিনটন, সেখানে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন বরং তাকে নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে খর্ব করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে রাশিয়া- এমন দাবির পক্ষে আলামত ক্রমেই বাড়ছে। ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের ঘণ্টা কয়েক আগে হ্যাকাররা যখন দলটির জাতীয় কমিটির (ডিএনসি) ই-মেইল ফাঁস করে, ইন্টারনেট নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সেখানে রাশিয়ান সংস্থার জড়িত থাকার আলামত পেয়েছেন।
সম্প্রতি মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ তুলেছে। এই বাগড়া দেয়ার লক্ষ্য হলো স্পষ্টতই ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারির ক্ষতি করা। হিলারিকে কেন ভয় পান পুতিন, তা দেখা সহজ। হিলারির হোঁচট খাওয়া আর কাশি দেয়ার ঘটনা সামনে এনে তাকে দুর্বল প্রমাণ করে ভোট আদায় করতে চাইছে ট্রাম্প শিবির। অপরদিকে পুতিন মনে করেন হিলারি হলো তার উদ্দেশ্যসাধনের পথে সত্যিকার বাধা। পুতিনের জন্য হিলারিকে থামানোটা শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কোনো কৌশলগত লক্ষ্যই নয়। এখানে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও আছে।
২০১১ সালের দিকে, রাশিয়ায় পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটিই দেশটিতে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিক্ষোভ। তিনি সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ কাটান। কিন্তু ২০০৮ সালে তিনি বনে যান প্রধানমন্ত্রী। এ কৌশল খাটিয়ে তিনি মিত্র দিমিত্রি মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্ট বানান, আর কার্যত প্রকৃত ক্ষমতা ধরে রাখেন নিজের কাছেই। এরপর তিনি ঘোষণা দেন তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন তিনি। এতে অনেকে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তবে অবাক হওয়ার মতো কিছুই ছিল না। তিন মাস পর, বিরোধীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে যখন আইনসভা নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করেন পুতিন। ওই নির্বাচনে প্রতারণার অভিযোগ ছিল ব্যাপক।
তখন মস্কোর হিমশীতল তাপমাত্রার মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ রাজপথে বিক্ষোভ দেখায় সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে। তারা পুতিনের শাসনের অবসান দাবি করে। অনেক পোস্টারে আর মানুষের স্লোগানে শোনা যায়: পুতিন ইজ অ্যা থিফ!
শিগগিরই পুতিনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দেখা দেন হিলারি ক্লিনটন। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি প্রকাশ্যে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি বলেন, ‘অন্য যেকোনো দেশের মতো রাশিয়ান জনগণেরও একটি মুক্ত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রাপ্য।’
ক্ষোভে যেন তখন ফেটে যাচ্ছিলেন পুতিন। তিনি প্রতিবাদের দায় চাপালেন হিলারির ওপর। অভিযোগ করলেন, হিলারি বিরোধীদের কাছে ‘বার্তা’ পাঠাতে চাচ্ছেন।
হিলারির প্রতি পুতিনের এ ব্যক্তিগত দ্বেষের সঙ্গে মিলে যায় তার দূরদর্শী এক কৌশলগত লক্ষ্য। কয়েক বছরে, তিনি পুরুষালি বলিষ্ঠ পররাষ্ট্র (ও ঘরোয়া) নীতি চালু করেছেন। তিনি প্রত্যেক কদমে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে। ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি সত্ত্বেও, বৈশ্বিক ময়দানে বড় খেলোয়াড় হিসেবে জাহির করতে নিজের সামরিক শক্তিমত্তাকে ব্যবহার করেছে রাশিয়া। অথচ, দেশটির অর্থনীতি মেক্সিকোর চেয়েও অত বড় নয়।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমের উদারনৈতিক ডেমোক্রেটিক কাঠামোকে খাটো করতে ও আটলান্টিকের দুই প্রান্তের সম্পর্ককে ছোট করতে রাশিয়া এক ধরনের প্রচার শুরু করেছে। তিনি এজন্য ইইউর বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে ব্যবহার করেছেন ও উগ্র ডানপন্থিদের সমর্থন করছেন। এই ক্রেমলিন প্লেবুকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করার কৌশলও অন্তর্ভুক্ত।
পুতিনের এ লক্ষ্যের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান হিলারির। ইতিমধ্যে তিনি অংশত মাঠে নেমেই আছেন। পুতিনের লক্ষ্য হলো সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা ও হালকা প্রভাবে রাখা পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপকে। আর ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোকে দুর্বল রাখা।
হিলারি কয়েক বছরে অসংখ্য মন্তব্য করেছেন যে, তিনি পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চেয়েও শক্ত অবস্থানে থাকবেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপ ও ইউরোপ ছাড়িয়ে রাশিয়ান আগ্রাসনকে তিনি ঘিরে ফেলবেন, নিয়ন্ত্রণে রাখবেন ও নিবৃত্ত করবেন। কিন্তু ট্রাম্প এখানে হিলারির পুরোই বিপরীত।
যেখানে হিলারি আমেরিকার অবস্থানকে আরো কঠোর করতে চান, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সেখানে রাশিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে স্বীকৃতি দেবেন, যেটি ইউক্রেন থেকে পুতিন বলপ্রয়োগ করে ছিনিয়ে নিয়েছেন। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবরোধ বাতিল করতে পারেন। এমনকি তার সিরিয়া নীতি মিলে যাবে পুতিন ও আসাদের সঙ্গে।
রিপাবলিকান প্রাইমারি চলাকালে, রাশিয়ার সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের ব্যর্থ কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টায় নেতৃত্বদানের জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হন হিলারি। কিন্তু রাশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক ম্যাকফল বলেছেন ওবামা প্রশাসনের ওই পরিকল্পনা নিয়ে বরং সংশয়ে ছিলেন হিলারি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আসার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার সমালোচনা আরও বেড়ে যায়।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলকে পুতিন রাশিয়ান সংখ্যালঘুদের রক্ষার অজুহাত দিয়ে জায়েজ করলেন। তখন হিলারি বলেছিলেন, হিটলার যখন পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপ দখল করেন, তখন তার অজুহাতও পুতিনের মতোই ছিল। এছাড়া রাশিয়ার ব্যাপারে ওবামার নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া নিয়েও কিছুটা সমালোচনা করেছেন হিলারি। তিনি বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা ও ক্রিমিয়া দখলের প্রতিক্রিয়ায় আরও কিছু করার পক্ষে আমি।’
পুতিন একপর্যায়ে হিলারির নাম ধরেই আক্রমণ শুরু করেন। পাল্টা হিলারিও ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে নামেন। গত বছরের এক বক্তৃতায় হিলারি বলেন, আমি এখনও মনে করি, রাশিয়া ও বিশেষ করে পুতিনের কষ্টটা বাড়ানো দরকার আমাদের। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ওই ইস্যুতে ট্রাম্প শিবির যে প্রস্তাব দিয়েছে তা পরস্পরবিরোধী। তবে সর্বশেষ বিতর্কে ট্রাম্প দৃশ্যত পুতিনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।
সিরিয়া সংকটের ব্যাপারে খুবই সংযত আচরণ করেছেন ওবামা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে বহুবার পাঠিয়েছেন রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কূটনৈতিক দীর্ঘ আলোচনায় বসতে। এগুলোর কোনোটিই কোনো ফল বয়ে আনেনি। অথচ, রাশিয়া আসাদের সমর্থনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমাবর্ষণ করেই যাচ্ছে। কিন্তু হিলারি সিরিয়ায় ‘নো-ফ্লাই’ জোন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ নো-ফ্লাই জোন শুধু সিরিয়ান সেনাবাহিনীকেই নয়, রাশিয়াকেও অনুসরণ করতে বাধ্য করবে। তিনি এখন বলেছেন, তিনি রাশিয়ানদের অবহিত রাখবেন, যাতে কোনো সংঘাত না বাধে। তার ভাষায়, ‘আমি সবাইকে আলোচনার টেবিলে রাখতে চাই।’ এরপরও বর্তমান মার্কিন নীতিতে এটি বাস্তবায়ন হলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। আর এটিই পুতিনকে গভীরভাবে অস্বস্তিতে ফেলতে যথেষ্ট। কয়েক বছর আগে পুতিনকে আনমনে হিলারির সম্পর্কে বলতে শোনা যায় যে, ‘মহিলাদের সঙ্গে তর্ক না করাটাই ভালো।’ এখন ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে কেন প্রেসিডেন্ট হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তর্ক করা থেকে বচতে এতদূর যেতে প্রস্তুত পুতিন।

(দ্য মায়ামি হেরাল্ড ও ওয়ার্ল্ড পলিটিকস রিভিউয়ের কলামনিস্ট ফ্রিদা গিদিস। তিনি সিএনএন-এর সাবেক প্রযোজক ও প্রতিবেদক। সিএনএন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার ‘হোয়াই পুতিন ফিয়ারস আ ক্লিনটন প্রেসিডেন্সি’ শীর্ষক কলাম অনুবাদ করেছেন  নাজমুল আহসান)

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031