প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু-কিশোরদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন । গতকাল রাজধানীর কৃষিবিদ মিলনায়তনে শেখ রাসেলের ৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি চাই না এদেশে কোনো জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ থাকুক। কারণ এই জঙ্গিবাদের সত্যিকার আঘাতটা আমরাই পেয়েছি। আমি চাই এদেশ একটি শান্তির দেশ হবে। উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ হবে। আমি জানি এটা অর্জন করা খুব কঠিন। আজকে বাংলাদেশ যে পর্যায়ে এসেছে তা আনতে প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক সংগ্রাম-ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সেজন্য আজকের শিশু এবং আগামী দিনের কর্ণধারদের আমি বলবো দেশের জন্য, জাতির জন্য সবসময় যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ মহান ত্যাগের মধ্য দিয়েই যেকোনো মহান উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়, জাতির পিতা এটাই আমাদেরকে শিখিয়েছেন। তিনি গুরুজনকে সম্মান জানানোর জন্য আগামী প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পিতা-মাতা, শিক্ষক তাদেরকে সম্মান করতে হবে। বড়দের কথা শুনতে হবে। নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। আর মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ জন্যই আমরা প্রযুক্তি শিক্ষাকে সব থেকে গুরুত্ব দিয়েছি। একটা মানুষও এদেশে ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না, শিশুরা শিক্ষার জন্য সবাই স্কুলে যাবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। তাদের মেধাবিকাশের সুযোগ হবে-এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। শেখ রাসেল শিশু- কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রাকিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, সংগঠনের উপদেষ্টা সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এমপি, মহাসচিব মাহমুদুস সামাদ এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক মুজাহিদুর রহমান এবং লায়ন মো. মজিবুর রহমান হাওলাদার। সংগঠনের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি কে এম শহীদুল্লাহ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। শিশু নাফিস বিন নাদিম শিশুদের পক্ষে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ’৬৪ সালে রাসেলের যখন জন্ম হয় তখন আব্বা (বঙ্গবন্ধু) নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সর্বদলীয় বিরোধী দলের প্রার্থী করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আব্বা তখন নির্বাচনের কাজে চট্টগ্রামে। আইয়ুব খানের মার্শাল ল’র যুগ সেটা। সেই সময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাসেলের জন্ম। জন্মলগ্ন থেকে সকলের মাঝে বেড়ে উঠলেও পিতৃস্নেহ সে খুব কমই পেয়েছে। ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দিলেন এই ৬ দফা প্রচার করতে গিয়ে বারবার তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ৮ই মে ছোট্ট রাসেলের কাছ থেকে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করে নেয়ার পর ’৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। সেই ছোট্ট রাসেলকে কিন্তু সবসময় পিতার স্নেহ বঞ্চিতভাবে বড় হতে হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, যখনই আমরা কারাগারে যেতাম দেখা করতে তাকে (রাসেল) নিয়ে আসা কঠিন ছিল, অনেক কষ্ট করে তাকে নিয়ে আসতে হতো। তখন তো কথাও বলতে শুরু করেনি। এরপর যখন কথা বলতে আরম্ভ করলো সে বাবাকে খুঁজে বেড়াতো। তাই হয়তো খেলার সময়ও কিছুক্ষণ পর পর সে বাবাকে একবার দেখতে যেত, তার মনে হয়তো হারাবার ভয়টা কাজ করতো। প্রধানমন্ত্রী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, মাঝে মাঝে মা রাসেলকে সান্ত্বনা দিতো-আমিই তোমার বাবা আবার আমিই তোমার মা। এরপর যখন কারাগারে আমাদের সঙ্গে বাবাকে দেখতে যেত সে একবার বাবাকে আব্বা বলে ডাকতো আবার একবার মাকে আব্বা বলে ডেকে হতবিহ্বল হয়ে পড়তো। এভাবেই ছোট্ট রাসেল বেড়ে উঠেছে। এরপর ’৬৮ সালে বাবাকে ক্যান্টনমেন্টে ৬ মাস বন্দি করে রাখলো, আমরা তার কোনো খবর পাইনি, তিনি বেঁচে আছেন কিনা- সে খবরও আমাদের কাছে ছিল না। তখন শিশু রাসেল মাঝে মধ্যেই রাতে খুব কান্নাকাটি করতো। আমরা সবাই আসতাম তাকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু আমরা কি সান্ত্বনা দেব, আমরাও তো বাবার স্নেহবঞ্চিত। মুক্তিযুদ্ধকালীন ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি থাকাবস্থায় সঙ্গীহীন রাসেলের দুঃসহ জীবনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর কেবল সাড়ে ৩ বছর সে পিতৃস্নেহ পেয়েছে। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে তাকে শাহাদাতবরণ করতে হয়েছে। ঘাতকরা তাকেও ছাড়েনি। সবার শেষে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করলো। কত ছোট্ট একটা জীবন রাসেলের। একটা উদ্দেশ্য হয়তো ঘাতকদের ছিল, বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাউকে বাঁচিয়ে না রাখা। সবার শেষে এই অবুঝ শিশুটিকেও কষ্ট দিয়ে তারা হত্যা করলো। চিরকালই পিতৃস্নেহবঞ্চিত রাসেলকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবসময় ব্যস্থ থাকতাম লেখাপড়া নিয়ে, বাবা কারাগারের বাইরে থাকলে ব্যস্ত থাকতেন তার সংগঠন নিয়ে, মা সংসার সামলানো ছাড়াও বাবার মামলা মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন-কাজেই রাসেলকে অনেক সময় একা বাড়িতে থাকতে হতো, সেই সময়টা ওর জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। তিনি বলেন, তারপরেও আমরা যতটুকু সময় পেতাম ওকে (রাসেলকে) সময় দিতে চেষ্টা করতাম। আজকে বেঁচে থাকলে কত বড় হতো? সেটা মাঝে মধ্যেই চিন্তা হয়। শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ১৫ই আগস্টের বিয়োগান্ত অধ্যায় স্মরণ করে বলেন, ঐ ধানমন্ডির বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে আছে পিতার লাশ, নিচে পড়ে আছে ভাইয়ের লাশ, মায়ের লাশ সেখান থেকে নিয়ে রাসেলকেও হত্যা করা হলো। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটুক আমরা চাই না। কারণ ১৫ই আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে একমাত্র কারবালার ঘটনার সঙ্গেই এর তুলনা চলে। কারবালাতেও হয়তো শিশুদের এভাবে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু এখানে অসহায় নারী, সন্তান সম্ভবা স্ত্রী, শিশু কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ইনডেমনিটি আইন করে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, শেখ রাসেলসহ ১৫ই আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিচারের পথ রুদ্ধ করায় জিয়াউর রহমান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। শেখ রাসেল স্মরণে আয়োজিত শিশু-কিশোর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কারও বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031